সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

জ্ঞানের সংকট ও প্রকৃত জ্ঞানের খোঁজে 

রুদ্র ইকবাল
  ১২ জুলাই ২০২৩, ১৪:৪০
জ্ঞানের সংকট ও প্রকৃত জ্ঞানের খোঁজে 
জ্ঞানের সংকট ও প্রকৃত জ্ঞানের খোঁজে 

কোন বিষয়ের পুরোপুরি অনুকরণ ও পর্যাপ্ত তথ্য মুখস্থ করায় প্রকৃত জ্ঞান না। তবে বর্তমান সময়ে তথ্য মুখস্থকরণ এবং উপলব্ধিহীন পাঠকেই জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মানুষ যদি জ্ঞানের সঠিক স্বরূপ উদঘাটন করতে না পারতো কিংবা পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত শুধু অনুকরণ বা অনুসরণের উপর নির্ভর করত তাহলে সে নিজেকে এবং তার বুদ্ধিমত্তাকে আবিষ্কার করতে পারতো না। প্রকৃত জ্ঞান হলো চিন্তার সাথে সত্যের সংযোগ, কোন বিষয়ের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চূড়ান্ত স্বরূপ উদঘাটন করে সত্য উপলব্ধি'ই করায় জ্ঞান।

প্রতিষ্ঠানিক ও গতানুগতিক জ্ঞান অর্জনে তথ্যের মুখস্থকরণ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে বরং সৃষ্টি করছে অহংকারী ও নৈতিকতাবিহীন জ্ঞানী। যারা জ্ঞানের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করতে পারে ও চিন্তার সাথে সত্যের সংযোগ সৃষ্টি করতে পারে তারা কেবল বিনয়ী হয়ে উঠে। যারা স্বরূপ উদঘাটনে ব্যর্থ হয় তারা অহংকারী হয়ে উঠে। এই অহংকার বৃদ্ধি পায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক হওয়ায়, কখনো বা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী হওয়ায় কিংবা শ্রেণির প্রথম সারির শিক্ষার্থী হওয়ায়। আহমদ ছফা জ্ঞানের অহংকার নিয়ে বলেন, ''বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের চেয়ে অহংকারটাই বেশি শিখে।''

সত্য ও প্রকৃত জ্ঞানের স্বরূপ উদঘাটন নিয়ে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎশের মত হলো, ''পৃথিবীর সব বস্তুকে একেকটা নির্দিষ্ট রূপক অর্থ দিয়ে মানুষ নিজেদের মতো করে নাম দিয়েছে এবং তাকে প্রতিষ্ঠা করেছে পূর্ণাঙ্গ সত্য হিসেবে। প্রত্যেক বস্তুর আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রত্যেক বস্তুকে বুঝতে হলে ঐ বস্তুর মধ্যে লুকায়িত সত্য ও স্বাতন্ত্র্যবোধ খুঁজতে হবে। এই স্বাতন্ত্র্যবোধ খুঁজে বের করার মধ্য দিয়েই সেই বিষয় বা বস্তুর স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব যা প্রকৃত সত্য ও জ্ঞান"।

নীৎশের মতে, ''মানুষ সমাজ কর্তৃক স্ক্রিপ্টেড জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হয় কিন্তু এই জ্ঞানের স্বরূপ না জানার কারণে জ্ঞানের দম্ভ করে বেড়ায় তার মাধ্যমে সে নিজের দুর্বলতায় প্রকাশ করে দেয়। অনেক সময় সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত সত্য প্রকৃত সত্য উদঘাটনের পথে বাধা হয়েও দাঁড়ায়। সত্যের ছোয়া বিহীন জ্ঞানীরা মনে করে তাদেরকে নিয়ে সাধারণ মানুষ চিন্তা করে ও এবং জ্ঞানী ভাবে। এর রহস্য হলো- প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবগত না হওয়া। মানুষ যতই সত্য উপলব্ধি করতে পারে ততই সে দম্ভ থেকে মুক্ত হয়ে উঠে এবং প্রকৃত জ্ঞানী হয়ে উঠে।''

সমাজ কর্তৃক তৈরী রূপক সত্যকে প্রকৃত সত্য হিসেবে মেনে নেওয়ার যে রীতি চলমান তা প্লেটোর এলিগরি অব দ্য ক্যাভ থিওরির সাথে মিলে যায়। যেখানে প্লেটো দেখায়, কিছু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একটি গুহায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় বন্দী থাকে। তাদের সামনে কিছু প্রাণীর ছায়া ভেসে উঠত তারা সে ছায়াকেই প্রকৃত সত্য হিসেবে মেনে নিতো। বন্দীদের মধ্য থেকে একজন একদিন মুক্ত হয়ে গুহার বাইরে চলে আসে এবং আবিষ্কার করে প্রকৃত সত্য সে বুঝতে পারে যে ছায়াকেই তারা সত্য হিসেবে বিবেচনা করতো তা নিছক ভ্রম।

প্লেটো তার এই থিওরির দ্বারা তুলে ধরেছেন, সমাজ দীর্ঘদিন ধরে যে বিষয়কে সত্য বলে আসতেছে তা মিথ্যাও হতে পারে। প্রকৃত সত্য উপলব্ধি ও আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন সমাজ কর্তৃক তৈরী জ্ঞানের শেকল ভাঙা।

সত্য ও সত্যের পথ খুঁজতে বিখ্যাত লেখক এমারসন লিখেছেন 'সেল্ফ রেলিয়েন্স'। এই প্রবন্ধে তিনি বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের প্রতি। পৃথিবীর অন্য কিছুর প্রতি বিশ্বাসের আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে বলেছেন। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলেই মানুষ সত্য ও জ্ঞানের সন্ধান পাবে, পাবে ঐশী আলোর সন্ধান। নিজের পথে চলতে গিয়ে সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত সত্য যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করতে বলেছেন। পৃথিবীর প্রকৃত জ্ঞানীরা নিজ পথে ভ্রমণ সত্যের স্বরূপ উদঘাটন করেই পৃথিবীকে দিয়েছেন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য। একজন মানুষ জীবন ও জগৎ থেকে যে রহস্য উদ্ধার করতে পারে যদিও তা সমাজস্বীকৃত নয় তাই তার জ্ঞান, তাই সত্য। কাজী নজরুল ইসলাম 'আমার পথ' প্রবন্ধে দৃঢ় চিত্তের সাথে উল্লেখ করেছেন- ''আমার সত্যই আমার পথ।''

সক্রেটিস আবার নৈতিক উৎকর্ষের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সক্রেটিসের মতে, মানুষ যখন নৈতিক ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং সত্যের খোঁজ করে তখন সে আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও বাস্তবিক সত্য সম্পর্কে অবগত হতে থাকে। আর এই সত্যই হলো জ্ঞান। সক্রেটিসকে এই সত্য ও তার উপলব্ধ জ্ঞান আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তৎকালীন রাজা কর্তৃক হেমলক পান করানো হয়, মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়।

অনুকরণের যুগে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে মানুষ ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ এমারসন বলেছেন, ''অন্যকে অনুকরণ'ই হলো আত্মহত্যা''। অনুকরণ বিহীন সত্য উপলব্ধির দ্বারা মানুষ প্রকৃত জ্ঞানের নিকটে যায় এবং এই জ্ঞানের উৎকর্ষতাই তাকে জ্ঞানের দম্ভ, অনৈতিক হওয়া থেকে রক্ষা করবে। যে যত স্বরূপ উদঘাটন করতে পারবে সে তত সত্য জানবে, সে ততই প্রকৃত জ্ঞান আবিষ্কার করতে পারবে।

লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে