সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

জীবন সংগ্রামী সঞ্জীবনী সুধা

মন্তোষ চক্রবর্তী
  ১৮ জুলাই ২০২৩, ১৪:৩৩
জীবন সংগ্রামী সঞ্জীবনী সুধা
জীবন সংগ্রামী সঞ্জীবনী সুধা

সঞ্জীবনী সুধা, এই প্রথম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শর্ত পূরণ করে এমফিল করতে যাচ্ছেন। সঞ্জীবনী, তার এমফিল প্রস্তাবনার বিষয় ‘রিফ্রেমিং জেন্ডার ইন পলিটিকস অব বাংলাদেশ সঞ্জীবনী সুধা টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলায় তার জন্ম। শৈশব ও কৈশোর সেখানেই কেটেছে। দুই বোনের ছোট্ট সংসার। বাবা প্রথমে পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন পরে চাকরি ছেড়ে স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা কখনো আবার ব্যবসা করতেন। মা এক সময় ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন পরে ব্যবসা করতেন। তবে এখন গৃহিণী। শৈশব থেকেই তার জীবন সংগ্রামে বেড়ে ওঠা। স্কুল-কলেজ, পাড়া-প্রতিবেশী তাকে ভিন্ন চোখে দেখত। স্কুলে ছেলে বা মেয়েদের সঙ্গে একসঙ্গে বেঞ্চে বসতে দেওয়া হতো না। আলাদা বেঞ্চে একা একা বসতে হতো তার। কিন্তু সবার এই আড়চোখ তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। মেধা, দৃঢ় মনোবল, মনন আর শ্রম দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন নিজেই। সঞ্জীবনী সুধা নিজ উপজেলা থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করে ভর্তি পরীক্ষা দেন রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সুযোগ পান মেধার ভিত্তিতে সুধা রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তাকে ছেলেদের হলে সিট পড়ে। চুল ছোট রাখতে হবে। এমন অসংখ্য শর্ত দেওয়া হয়। সবকিছু জয় করে সেখান থেকেই অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করতে আবেদন করেন। সব শর্ত পূরণ করে তিনি এমফিল শুরু করতে যাচ্ছেন। এমফিল শেষ করে পিএইচডি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার ইচ্ছেও রয়েছে তার।

বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।

প্রথম দিনের স্কুলের কথা বলতে গিয়ে সঞ্জীবনী সুধা বলেন সেই দিনের ভয়াবহতা : স্কুলজীবনের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বারবার চোখে পানি এবং গলায় বেশ আড়ষ্ট হয়ে আসছিল সুধার। কারণ সব থেকে বেশি তিনি স্কুল ও কলেজের সহপাঠীদের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। সঞ্জীবনী বলেন, প্রথম দিনের স্কুল নিয়ে বলেন, ৬ বছর বয়সে আমার বাবা যখন আমাকে স্কুলে নিয়ে যান ধনবাড়ী উপজেলার উত্তর পাড়া শিশু কানন স্কুলে তখন আমার আচরণ, কথা বলার ধরন দেখে সেই স্কুলের একজন শিক্ষিকা (ম্যাডাম) আমাকে ছেলেমেয়ের বেঞ্চে না বসিয়ে আমাকে আলাদা করে বসান। বসানোর পর ম্যাডাম আমাকে বলেন, তুমি ওদের সঙ্গে বসবে না। সব সময়ই আলাদা বসবে। আসলে তখনই আমাকে পৃথক করা হয়ে গেছে এই সমাজ থেকে। সেটা আমি এখন পর্যন্ত লালন করছি। যদিও সেই ম্যাডামের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি সুধা। এরপর থেকে সহপাঠী, শিক্ষক, শিক্ষিকা এমনকি পাড়া প্রতিবেশী সবাই আমার সঙ্গে আলাদা রকমের আচরণই করত।’

আমি যখন স্কুলে যেতাম তখন অনেক বন্ধুরা আমার শরীরের উপরে বোতলে করে প্রস্রাব ঢেলে দিত। আমাকে নিয়ে মজা নিত। কেন আমি স্কুলে যাই। কেন আমি বাড়িতে থাকি না। আমার মতো কেউ এলাকায় ছিল না। তাই প্রতিনিয়ত আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। তিনি বলেন, অসংখ্যবার নিজের জীবন শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলাম, কিন্তু আমার মা সব সময় আমাকে সাপোর্ট দিতেন আর বলতেন তোকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।

সামাজিকভাবে পরিবার নিয়ে কেমন ছিলেন? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সমাজের মানুষের সহযোগিতা পাওয়াটা দুষ্কর ছিল। তার মতো সন্তানকে সমর্থন দেওয়ার কারণে তার মা-বাবাকে সমাজের কাছে প্রায়ই হতে হয়েছে লাঞ্ছনার শিকার। এ সম্পর্কে সঞ্জীবনী সুধা বলেন, ‘আমার জন্য পরিবারকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। মা-বাবাকে সমাজে কাছে হতে হয়েছে লাঞ্ছনার শিকার। এখনো একই রকম আছে। এখনো গ্রামের বাজারে আমার বাবা’কে অসংখ্য বার প্রকাশ্যে অপমানিত হয়ে চোখের পানি ঝরাতে হয়েছেÑ মা’কে সমাজিক অনুষ্ঠানে অপমানিত হতে হয়েছে। আমার অবস্থার হয়তো পরিবর্তন হয়েছে। সুশীলদের সঙ্গে ওঠাবসা বা অন্য সমাজে বসবাস করি। গ্রামে এখনো আমাদের মতো সন্তানদের জন্য পরিবারকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়। কয়েক বছর আগেও আমাদের একঘরে রাখা হতো। অন্য পরিবারের সঙ্গে মিশতে দেওয়া হতো না। মা-বাবাকে এখনো হেয় প্রতিপন্নতার শিকার হতে হয়। এটি আসলে এক বর্বর সমাজের প্রতিচ্ছবি। খারাপ লাগে, আমার মতো সন্তান জন্মগ্রহণ করার মতো পরিবারকে এত কষ্ট সহ্য করতে হয়। ভবিষ্যতেও হয়তো সমাজে কথা শুনতেই হবে। তবে এতকিছুর পরও মা-বাবা আমাকে যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছেনÑ যা আমার জীবনে ছিল সবচেয়ে পাওয়া এবং এতটুকু আসার পেছনে মা-বাবার অবদান অপরিসীম।

এমফিলের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঞ্জীবনী সুধা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধীনে অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীনের তত্ত্বাবধানে এমফিল করতে যাচ্ছেন সঞ্জীবনী। তার এমফিলের প্রস্তাবনার বিষয় ‘রিফ্রেমিং জেন্ডার ইন পলিটিকস অব বাংলাদেশ’। যুক্ত হবেন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এমফিল প্রোগ্রামে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জেন্ডারভিত্তিক কাজই আমার এমফিলের বিষয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া জনগোষ্ঠী রাজনীতিতে কীভাবে রিফ্রেম হচ্ছে বা কীভাবে রিফ্রেম হয়। এমফিল শেষে তিনি আরও উচ্চশিক্ষা করবেন বলেও জানান তিনি।

বয়ঃসন্ধিকালের বিষয় সুধা বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে পরিবর্তন ছিল অত্যন্ত কষ্টের এই সময় পা রাখা ছিল খুব বেশি দুর্বিষহ এবং চ্যালেঞ্জিং সঞ্জীবনীর। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি নিজেকে নারীই মনে করতাম; কিন্তু যখন বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হলো, তখন দেখা গেল আমার বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তন আসা শুরু করল। আমাদের যে পরিবর্তনটা হয় একেবারে অন্য রকমের। না সেটা একজন মেয়ের মতো, না একজন পুরুষের মতো। আমি কথা বলার সময় এটি খুবই দুর্বিষহ ব্যাপার ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটানো সময়গুলো কেমন ছিল? এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে সঞ্জীবনী সুধা বলেন, স্কুল-কলেজে যেভাবে হেনস্তার শিকার হয়ে ছিলেন সঞ্জীবনী তার চেয়ে কিছুটা কম হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। শিক্ষক ও সহপাঠীদের বেশ সহযোগিতা পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনো অনেকে এটা ভাবতেও পারত না। যখন আমি হেঁটে যেতাম সবাই হা করে তাকিয়ে থাকত। তবে হাই-স্কুল, কলেজের যে জীবন ছিল তার চেয়ে কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে, আমি যখন নৃত্য করতাম তখন নিজেকে বেশ শান্তি পেতাম। একমাত্র নৃত্যের সময় মনে হতো এখানে কোনোরকম ভেদাভেদ নেই এখান কোনো বৈষম্য নেই।

যৌন নির্যাতনের শিকার সম্পর্কে সঞ্জীবনী বলেন, প্রথমদিন আমার যখন ৫ বছর বয়স ছিল তখন আমার মা একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন সেইখানে মার এক ছাত্রের দ্বারায় প্রথম যৌন হয়রানি হয়েছিলাম। এরপর স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বহুবার শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। প্রথম দিনের ভয়নক স্মৃতি এখনো পিছু ছাড়েনি তার। সঞ্জীবনী বলেন, ‘বহুবার এমন নির্মমতার সম্মুখীন হয়েছি আমি। সহপাঠী, বন্ধু ও আশপাশের মানুষের দ্বারাই এসব ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু সবকিছুর তো একটা মাত্রা থাকে। আমার ক্ষেত্রে সেটা অতিমাত্রায় হয়েছে, জঘন্যভাবে হয়েছেÑ যা এখন বর্ণনা করতে গেলেও কঠিন।’

লিঙ্গ পরিবর্তন নিয়ে জানান, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু প্রসেস ফলো করতে হয়েছে। এ বিষয়ে সুধা বলেন, ‘এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটা এক দিনে সম্ভব হয় না। আমরা যারা করেছি তাদের ওষুধ সেবন করতে হয় আজীবন। কিংবা হরমোন নিতে হয় সারাজীবন। এটা বলা যায় যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে আমাকে।’

করোনা মহামারিতে কেমন কেটেছে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে করোনা মহামারি দেখা দেয়, তখন আপনজনকে ফেলে রেখে চলে যান অনেকে। সে সময় এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন সঞ্জীবনী। বীভৎস সেই সময়ে করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফন-সৎকারের কাজে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে। তখন দুবার করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। সেই সম্পর্কে সঞ্জীবনী বলেন, ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আমি তখন চাকরি করতাম। করোনা মহামারিতে অনেক স্বজন লাশ রেখে পালিয়ে যেতেন। এই করুণ দৃশ্য আমাকে ব্যথিত করেছে। পরে কর্তৃপক্ষকে আমি করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফন-সৎকার করাতে রাজি করাই। চট্টগ্রামে আড়াই মাস এই কাজ করি। ঢাকায় এসে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের হয়ে প্রায় এক বছরে দেশি-বিদেশি প্রায় ১২০০ জনের বেশি মানুষের লাশ দাফন বা সৎকারের কাজ করেছি। এটি আমার কাছে একটি স্মরণীয় ঘটনা। তবে সেখানেও লাশের গোসল বা সৎকার করানোর নিয়ে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে তাকে।

সমাজে চলতে এখন কেমন মনে হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জীবনী বলেন, প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করতে হয়েছেÑ এখনো চলছে। তিনি বলেন, ‘শুধু আমি না, আমার মতো যারা আছেন তাদের সবাইকে একইভাবে জীবন চালাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলতে হয়। এই সমাজে আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে একটি পেশার সঙ্গে জড়িত। একজন ব্যাংকার, নৃত্যশিল্পী, অভিনয় শিল্পী, যখন আমি রিকশায় অফিসে যাই বা অন্য কোনো সামাজিক কাজে যুক্ত হই, তখন আমাকে কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। আমাকে বাধার কবলে পড়তে হয়। সেটি ভিন্ন কথা। আমাকে চলতে-ফিরতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে। আমার বেঁচে থাকার জন্য, মানুষ হিসেবে টিকে থাকার জন্য বা আমার জীবিকা নির্বাহের জন্য এই সমাজে যুদ্ধ করেই চলতে হয়। মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য আমাকে সংগ্রাম করতেই হয়।

কার প্রেরণায় এই পর্যন্ত আসা? এ বিষয়ে সঞ্জীবনী জানান, ছোটবেলা থেকেই তার শারীরিক অনেক সমস্যা ছিল। তখন থেকে নিজেকে নারী মনে করতেন। মা-বাবা অনুপ্রেরণা সব চেয়ে বেশি বড় মনে করেন। সঞ্জীবনী বলেন, ‘আমার চিন্তা, মেধা আর মননে তৈরি করেছি নিজেকে। আমি আমার মাকে দেখতাম। তাকে আমি আইডল মনে করি।

ভবিষ্যতে নিয়ে চিন্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। একজন মানুষ হিসেবে সম্মান পাওয়ার অধিকারটুকু সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই মানবিকতাই রয়েছে তার চিন্তার মূলে। ‘মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখুন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ নির্বিশেষে একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করুন, ভালোবাসুন। বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান। সমাজেকে কী বলল, তা পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে পথচলাকে আদর্শ করে তোলা। এই জন্য ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে আরও উচ্চশিক্ষায় নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমরা নারী, পুরুষ, ট্রান্সজেন্ডার সবাইকে নিয়েই সুন্দর একটি দেশ গড়তে এগিয়ে যেতে চান তিনি।

লেখক : সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে