সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

জাতীয় পার্টিতে ফের নাটকীয়তা

ইয়াছিন রানা
  ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০৯:০৪
জাতীয় পার্টিতে ফের নাটকীয়তা
জাতীয় পার্টিতে ফের নাটকীয়তা

ফের নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে আলোচনায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া দল জাতীয় পার্টি। এরশাদ না থাকলেও কারণে-অকারণে জাতীয় পার্টির নাটকীয়তা যেন শেষ হচ্ছে না। মঙ্গলবার দিনভর জাতীয় পার্টি হঠাৎ করেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দলের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি নিয়ে এ আলোচনার শুরু। বিষয়টি নিয়ে জবাব-পাল্টা জবাব শুরু হয় রওশন ও কাদেরপন্থিদের। প্রশ্ন উঠেছে এই নাটকীয়তার জন্ম দিল কে? খোদ জাতীয় পার্টি না-কি তৃতীয় কোনো পক্ষ? এর মধ্য দিয়ে সুবিধা নিতে কেউ কি ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে? বেশ কয়েকমাস ধরে জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্বের টানাপড়েন চলছে। এর মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারত গিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এর তিনদিন আগে ১৯ আগস্ট বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে জি এম কাদেরের স্থলে রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছেন এমন সংবাদে তোলপাড় শুরু হয়। তবে যাদের স্বাক্ষরে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষকে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে তারা নিজেরাই তা জানেন না বলে জানান। আর জি এম কাদেরের অনুসারীরা প্রকাশিত সংবাদে প্রথমে হতভম্ব হলেও পরে জানান এমন কিছু ঘটেনি।

জি এম কাদের এবং রওশন এরশাদ পক্ষের সারাদিন পাল্টাপাল্টি বিতর্ক শেষে জানা যায়, সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো সেই চিঠি ভুয়া। এরপরই নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

জানা যায়, মঙ্গলবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। এতে বলা হয়, দলের কো চেয়ারম্যানদের অনুরোধে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কো-চেয়ারম্যানরা হলেন, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম।

রওশন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় ‘অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে’ জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সেখানে বলা হয়, জাতীয় পার্টির একাংশের মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। রওশন লেখেন, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’

তবে যে বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে, তার কোনো ‘ভিত্তি নেই’ বলে দাবি করেছেন দলের মহাসচিব ও জি এম কাদেরপন্থি নেতা মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, ‘এই খবর ভুয়া। আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে এভাবে কারও চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘যাদের স্বাক্ষর করার কথা বলা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলছে, তাদেরকে ব্লাকমেইল করা হয়েছে। গত বছর রওশন এরশাদ চিকিৎসা শেষে যখন দেশে এসেছিলেন তখন যারা তাকে দেখতে গিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে এসব স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল। কোনো সভা তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেনি।’ তবে রওশনপন্থি বলে পরিচিত জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘তারা না মানলে বলেন রাস্তায় নেমে আন্দোলন করুক।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে মানবে না, এটা কোনো কথা? রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে বলেন।’

কিন্তু যে কো-চেয়ারম্যানদের অনুরোধের কথা বলা হচ্ছে- তারা এ বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন সংবাদ মাধ্যমকে। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমি কখনও রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করি নাই। এক বছর, দুই বছর আগের কোনো স্বাক্ষরকে কেন্দ্র করে এই ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ নেই।’

জাতীয় পার্টির আরেক কো-চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলাও বলেছেন, ‘রওশনকে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।’ বিবৃতিতে রওশনকে চেয়ারম্যান হতে প্রস্তাবকারী হিসেবে তার নাম ব্যবহারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাবলা বলেন, ‘জি এম কাদের এমপি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল আছেন। আমরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।’ রওশনের চেয়ারম্যান হওয়ার সংবাদে বিভ্রান্ত না হতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। রওশন-জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব শুরু যেখানে ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের। এরপর ভাবি রওশনের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দেয়। ওই পরিস্থিতিতে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও রওশনকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়।

এরপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের নাম ঘোষণা করেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ায়।

২০২২ সালের ৩১ আগস্ট হঠাৎ করেই এক চিঠিতে দলের কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন। সে সময় জি এম কাদেরের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই পদক্ষেপ ‘অবৈধ’, কারণ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল আহ্বানের ক্ষমতা আছে কেবল তার। এরপর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে আদালতেও মামলা করা হয়। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির দুই নেতা একসঙ্গে গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথাও জানানো হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে জাতীয় পার্টির। তবে জাতীয় পার্টির পুরো রাজনীতিই নাটকীয়তায় ভরা। নির্বাচন এলেই দলটিতে নাটকীয়তা শুরু হয়। কথায় কথায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে দলটির ওপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই ভরসা রাখতে পারে না। গত কয়েক মাস ধরেই জি এম কাদের সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করছিলেন না তিনি।

১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি বিএনপির জোটসঙ্গী হয়। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সে জোট থেকে বের হয়ে আসে। এ নিয়ে তখন দলে ভাঙন ধরে। একটি অংশ বিজেপি নামে দল গঠন করে বিএনপি-জামায়াতের জোটে থেকে যায়।

২০০৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালে জোটবদ্ধ হয়ে ফের ক্ষমতার অংশী হওয়ার স্বাদ নেয় দলটি।

২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদ একেক সময় একেক অবস্থান নেন। তবে ভোটের আগে আগে তার অসুস্থতার কথা বলে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি হওয়ার কথা জানা যায়। তখন বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একাংশ যায় ভোটে। সে সময় জি এম কাদের তার ভাইয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এরশাদও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তবে নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে নাম নাম থেকে যায়। রংপুর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি।

সে সময় বিএনপি বর্জন করায় জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে। আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরকারেও অংশ নেয় দলটি, এরশাদ নিজেও হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতা হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেওয়ায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির পাশাপাশি দেড় শতাধিক আসনে প্রার্থী দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। তবে নির্বাচনে জয়লাভের পর জাতীয় পার্টিকে আর মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি।

বর্তমানে জি এম কাদের আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এককভাবে লড়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু রওশন এরশাদ অবশ্য এ বিষয়ে এখনো কিছু বলেননি।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে