টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব আবার ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় দুই নেতার দ্বন্দ্বে তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার কথা থাকলেও সাড়ে ১০ মাসেও তা হয়নি। ফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব উপজেলা-ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার বিরোধী আন্দোলনও নির্দিষ্ট স্থানের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে অযোগ্যদের জেলা কমিটিতে পদায়ণের খবর চাউর হওয়ায় অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব আবার প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
জানাগেছে, ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনের পর টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায়। ওই সময় একাধিক গ্রæপে বিভক্ত হয়ে নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মসূচি পালন করে। নয়া আহŸায়ক কমিটি গঠন করার পরও দ্ব›েদ্বর অবসান না হওয়ায় আবার আহŸায়ক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দলীয় কোন্দল তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে গত বছরের ৪ নভেম্বর জেলা বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে দলীয় দ্ব›েদ্বর কিছুটা উপশম হয়। পৌরসভার পশ্চিম আকুরটাকুর পাড়া ঈদগাঁ মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে হাসানুজ্জামিল শাহীন সভাপতি ও অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপর সাড়ে ১০ মাস কেটে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। সম্প্রতি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান ও নির্বাহী কমিটির সদস্য ওবায়দুল হক নাছির- এই চারজন মিলে তাদের অনুসারীদের নিয়ে একটা প্রস্তাবিত কমিটি গঠন করেছেন। সেই প্রস্তাবিত কমিটির বিষয়টি জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানতে পেরেছেন। ওই প্রস্তাবিত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পদ প্রত্যাশি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, যারা ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন কমিটির নেতা হওয়ারও অযোগ্য- তাদেরকে জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হচ্ছে। সরকারের হামলা-মামলায় জর্জরিত ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের প্রস্তাবিত কমিটিতে স্থান দেওয়া হচ্ছেনা।
জেলা বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু’জনেই কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খানের অনুসারী। কাউন্সিলরদের ভোটে তাঁরা জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারীদের হারিয়ে দেন। এখন সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারীরা জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে গিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পরাজিত হওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইছেন। মূলত: যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারীরা রাজনীতির মাঠের বলিষ্ঠ কর্মী। পক্ষান্তরে কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খানের অনুসারীরা অনেকটা মঞ্চনির্ভর(পোষাকি) নেতা।
জেলা বিএনপির ত্যাগী হিসেবে পরিচিত নেতারা জানান, জেলা বিএনপি মূলত: দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। টাঙ্গাইল জেলায় কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানের একটি গ্রæপ এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নেতৃত্বাধীন অপর একটি গ্রæপ সক্রিয়। তারা নিজেদের পছন্দের নেতাদের জেলা কমিটিতে পদায়নে অধিক সুপারিশের কারণে কমিটি গঠনে সময় লাগছে। এছাড়া বিভিন্ন উপ-গ্রæপে দলীয় নেতাকর্মীরা বিভক্ত হওয়ায় কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে অধিকাংশ নেতাকর্মী অংশ না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তারা জানান, টাঙ্গাইল শহরে জেলা বিএনপির নিজস্ব কোন কার্যালয় নেই। দলের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল আইনজীবী হওয়ায় কোর্ট চত্ত¡রে বসে নিজস্ব বলয়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন। জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল শহরের প্রাণকেন্দ্র পৌর উদ্যান, নিরালা মোড়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, প্রেসক্লাবের কাছে দলীয় কর্মসূচি পালন না করে মূল শহরের বাইরে বেপারীপাড়ায় কর্মসূচি পালন করে থাকেন। সম্প্রতি দলীয় কয়েকটি কর্মসূচি শহরের মূল সড়ক প্রদক্ষিণ না করে যৌনপল্লীর সামনে দিয়ে মিছিল নেওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা মনে করে, জেলা বিএনপির ব্যর্থতার কারণে দলে অন্তঃকোন্দল উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলা বিএনপি সভাপতি আজগর আলী এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করছেন। সদর উপজেলার ১নং মগড়া ইউনিয়ন বিএনপির একটি কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আলাদাভাবে গঠন করেন। পরে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে ওই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
তারা আরও জানায়, জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শহরের উল্লেখিত জনবহুল এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের ভয়ে দলীয় সভা, সমাবেশ ও মিছিল করার সাহস পান না । শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে সভা, সমাবেশ ও মিছিল-মিটিং করা হয়। সারাদেশে বিএনপির দলীয় নেতাকর্মীদের নামে শ’ শ’ মামলা থাকলেও জেলা বিএনপির সভাপতির নামে মামলা তো দূরের কথা থানায় একটি জিডিও নেই। তিনি আওয়ামী লীগের সাথে আতাঁত করে চলেন বলে দলের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন।
জেলা বিএনপির সম্মেলনের দীর্ঘদিন পরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। তাই তাদের এখন জেলা কমিটির সাবেক নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে হচ্ছে। তারা দ্রæত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার আহŸান জানান।
জেলা বিএনপির সাবেক এক নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, সরকার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম যেখানে প্রকট রূপ ধারণ করেছে- সেই সময়ে জেলা বিএনপি একটি লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে ত্যাগী, যোগ্য এবং মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত নেতাকর্মীর স্থান নেই। জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের পছন্দের বির্তকিত নেতাদের দিয়ে পকেট কমিটি গঠন করার অপচেষ্টা করছে। তাদেরকেই প্রস্তাবিত কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে।জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মাহমুদুল হক সানু জানান, জেলা বিএনপির কমিটি কেনো গঠন হচ্ছে না তা কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান এবং জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ভালো জানেন। পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠন না করায় নেতাকর্মীরদের ক্ষোভ হতাশায় রূপ নিয়েছে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল জানান, চলতি মাসের মধ্যে জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের কোনো বিষয় নেই। এসব কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। প্রতিক্রিয়াশীলরা সব সময় নানা কথা বলে থাকে- তারা কল্পনাপ্রসূত কথা প্রচার করে সুবিধা নিতে চায়।
তিনি জানান, জেলা বিএনপি নিয়মিত শহরের ঈদগাঁ মাঠে সভা ও সমাবেশ করছে। ২-১ টা কর্মসূচি বেপাড়িপাড়ায় করা হয়েছে। কয়েকদিন আগেও ঈদগাঁ মাঠ থেকে একটি বিশাল মিছিল নিয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বেপাড়িপাড়ায় গিয়ে শেষ হয়। ওই মিছিলে প্রায় দশ হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত ছিল।টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন জানান, অযোগ্যরা জেলা কমিটিতে পদ পেতে নানাবিধ অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তারা জানেন- জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত নেতা। আওয়ামীলীগের সুবিধাভোগী নেতারাও জেলা কমিটিতে পদ পাওয়ার আশায় চেষ্টা-তদবির করছে। অনেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের পদ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করছে।
যাযাদি/ এস