দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ নেই এমন মানুষ খুঁজে পেতে কষ্ট হবে। দল দু’টির নীতি নির্ধারকরা এই প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব দিচ্ছেন যে, জাতীয় নির্বাচনের পথেই হাঁটবেন তারা। অর্থাৎ নির্বাচন বর্জন করবেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। উপরে আক্রমণাত্মক অবস্থানে থাকলেও তৃণমূলের অবদার মেটানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে বিএনপি। অন্যদিকে নমনীয় কৌশল অবলম্বন করছে জামায়াত। আগ্রহী নেতাকর্মীদের তারা বাধা তো দিচ্ছে না, কিছু ক্ষেত্রে প্রস্তুতিতে সহযোগিতাও করছে।
বিএনপি সূত্র মতে, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপিতে দুই ধরনের মত আছে। অংশগ্রহণের পক্ষেই অধিকাংশ নেতকর্মী। অংশ নেওয়ার পক্ষে থাকা নেতারা বলছেন, নির্বাচনে অংশ না নিলে মাঠপর্যায়ের হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীরা অন্য দলে যোগ দিতে পারেন। ফলে দলের সাংগঠনিক শক্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এছাড়া নির্বাচনে না গেলে রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে দল। আর বিপক্ষে থাকা নেতারা বলছেন, নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ নির্বাচনে গেলে নেতাকর্মীদের ওপর নতুন করে হামলা-মামলা বেড়ে যাবে। তাছাড়া এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না তা বার বার প্রমাণিত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে নির্বাচনে গিয়ে যেমন জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই, তেমনি সংসদ নির্বাচন পুনরায় অনুষ্ঠানের যে দাবি তোলা হয়েছে তা দুর্বল হয়ে পড়বে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপিতে দুই ধরনের মত নিয়েও উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। নীতি নির্ধারণী ফেরামের বৈঠকেও অংশগ্রহণের বিষয়ে অনেক নেতা ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এ নিয়ে জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলেবেন দলের নীতি নির্ধারণী ফোরামের নেতারা। তাদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দলের সিনিয়র এক নেতার মতে, শেষ পর্যন্ত দলের নেতাকর্মী আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি হাইকমান্ড নীরব থাকবে। এর কারণ হচ্ছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। তা সত্ত্বেও দলটির তৃণমূলের অনেক নেতা সেসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, কেউ কেউ বিজয়ীও হয়েছেন। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিএনপির কোনো কোনো নেতা দল থেকে বেরিয়ে অন্য দলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ফলে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে তৃণমূলের নেতাদের বিরত করা যাবে কিনা, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও।
ভেতরে ভেতরে যে আলোচনাই হোক না কেন প্রকাশ্যে এই নির্বাচন ইস্যুতে খুবই কঠোর বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে পরিষ্কার জানানো হয়েছে নির্বাচনে অংশ তো নেবেই না, কেউ অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে দল সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নেবে।
এদিকে বিএনপির সঙ্গে একমত হয়ে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা জামায়াতে ইসলামীও কৌশলগত কারণে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেবে না। তবে এই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা এবার স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেবে না। বিএনপিও এ নির্বাচনে আছে কৌশলী অবস্থানে। ফলে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে মূলত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। আর এই সুযোগটি জামায়াত কাজে লাগাতে চায় বলে জানা গেছে।
আলাপকালে জামায়াতের দায়িত্বশীল পর্যায়ের একাধিক নেতা প্রায় একই সুরে কথা বলেন। তাদের মতে, উপজেলা নির্বাচনে বড় দুই দল দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ না করায় স্বতন্ত্রভাবে সব প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং এলাকায় অবস্থানের বিষয় বিবেচনায় আসবে। এমন নির্বাচনে জামায়াত ভালো করবে বলেই দলটি মনে করে। এ কারণে সর্বশক্তি দিয়ে জামায়াত উপজেলা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইতোমধ্যে অন্তত ১৫০টি উপজেলায় কারা কারা প্রার্থী হবেন তাদের একটি তালিকা প্রস্তুতির কাজও শুরু করেছে তারা।
জামায়াত সূত্র মতে, দেশের দক্ষিণাঞ্চল, উত্তরাঞ্চলের জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি আগের চেয়ে বেড়েছে এবং তারা উপজেলা নির্বাচনে কতগুলো নির্দিষ্ট উপজেলাকে টার্গেট করে তাদের প্রচারণা চালাবে এবং একটি সম্মানজনক ফলাফল নিয়ে আসার জন্য জামায়াত সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে।
সম্প্রতি জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার বৈঠকে উপজেলা নির্বাচনকে নিজেদের সংগঠন গোছানো এবং জনপ্রিয়তা যাচাই একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। দায়িত্বশীল নেতাদের অধিকাংশই মত দেন যে, উপজেলা নির্বাচনে ভালো ফলাফল করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের সাংগঠনিক অবস্থাকে যেমন সংহত করতে পারবে ঠিক তেমনি তারা তাদের অবস্থান জানান দিতে পারবে। পাশাপাশি নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণের ক্ষেত্র হিসেবে উপজেলা নির্বাচনকে ব্যবহার করারও সুযোগ তৈরি হতে পারে।গত দেড় দশকে জামায়াতের নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর পরপরই দেশের স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন নির্বাচনেও অংশগ্রহণ ছিল দলটির। ২০১৩ সালের উপজেলা নির্বাচনে ৩৪ জন চেয়ারম্যান, ৩৬ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, ২৩৪ জন ভাইস চেয়ারম্যান বিজয়ী হন। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচার কাজ শুরু হলে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত। এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সবশেষ গত বছর ১৯ নভেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ মর্মে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বেঞ্চ। নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর জাতীয় কিংবা স্থানীয় কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী।
জানা গেছে, নিবন্ধন নিয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকায় আইনগতভাবে (দলীয় প্রতীকে) এখন নির্বাচন করতে পারবে না জামায়াত। কিন্তু দলের যে কোনো নেতা যে কোনো কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তাতে কোনো সমস্যা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভেতরে ভেতরে দল গোছানোর পাশাপাশি আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও প্রস্তুতি রয়েছে নিবন্ধনহীন দলটির। ৪৮১টির মধ্যে অন্তত দেড়শ’টি উপজেলায় জামায়াত প্রার্থী দেবে। নেতাদের দাবি, জামায়াতের প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। নিবন্ধন বাতিল হলেও তারা সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে চান। সেদিক থেকে বিকল্প পন্থাও খুঁজে নেওয়া হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের অবস্থান প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, এটা স্থানীয় নির্বাচন। এ ব্যাপারে দল আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। পাশাপাশি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে আলোচনারও বিষয় আছে।
যাযাদি/ এস