শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে

হাসান মোল্লা
  ১৮ মে ২০২৪, ০৯:৫৫
বিএনপির লগো

আন্দোলন বেগবান, কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার, সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি, মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ রাখার চাপ থাকলেও তা উত্তরণে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারছে না বিএনপি। ফলে দেড়যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে হাতাশা বাড়ছে।

বিএনপির সূত্রমতে, নির্বাচনের পরে ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনের ধারাবাহিক ব্যর্থতা বিএনপিতে হাতাশা বহু গুণে বাড়িয়েছে। এছাড়া ক‚টনৈতিক তৎপরতায় সফলতার আশা একরকম ফিকে হয়ে গেছে। নেতৃত্ব সংকট কাটাতে জাতীয় কাউন্সিল করারও চাপ থাকলেও আপাতত এর কোনো সম্ভাবনা নেই। পদ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বে আসা তৃণমূলের একটি বড় অংশ কেন্দ্রীয় নির্দেশনা আমলে নিচ্ছে না। এজন্য পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্চ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সূত্রমতে, সরকারকে বেকাদায় ফেলার মতো নতুন করে কঠোর আন্দোলন করার সক্ষমতা বিএনপির নেই। কারণ গত বছরের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে লাখো জনতার সমাবেশ মাত্র ১০ মিনিটেই পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হওয়ায় নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাসে চির ধরেছে। পরিকল্পনাহীন নতুন কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার প্রশ্নেও বিভক্তি বেড়েছে। এরপর কোনো প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি ছাড়াই ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় নেতাকর্মীদের মনোবল আরও ভেঙে গেছে। ফলে নেতাকর্মীরা ধরেই নিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছর মেয়াদের জন্যও আওয়ামী লীগ ক্ষমায় থাকছে। আন্দোলনের নামে রাজপথে এখন যেসব কর্মসূচি চলছে- সেগুলোও যেন শুধুই অস্তিত্ব রক্ষার। ফলে একদিকে হতাশা, ক্লান্তি নেতাকর্মীদের ঘিরে ধরেছে, অন্যদিকে সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও আছে হতাশা।

দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, আসলে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এমন উপলব্ধি আছে, গত কয়েক বছরে যত আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে-তার সবই ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাহীন। এজন্য পরিকল্পনা করে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। আপাতত গতানুগতিক কিছু কর্মসূচি ছাড়া বেশি কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।

আন্দোলনের বিষয়ে নীতি নির্ধারণী ফোরামের এক নেতা বলেন, সব নেতাকর্মীকে কারামুক্ত করে দলকে গতিশীল করার পাশাপাশি এখন কোন কৌশলে সাধারণ জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে বিএনপি হাইকমান্ড। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব নিজ দলের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দল, শুভাকাক্সক্ষী, সুশীল সমাজ ও পেশাজীবী নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশ, গণতন্ত্র ও দলের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কী ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, তা নিয়ে মতবিনিময় করছেন তারা।

বিএনপি সূত্রমতে, আন্দালনের পাশাপাশি ক‚টনৈতিক তৎপরতায় গতি মন্থর হওয়ায় বিএনপিতে আছে হতাশা। আগের কূটনৈতিক কার্যক্রম বিশ্লেষন করে নেতারা এর কারনও বের করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনের আগে টানা দুই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একরকম নির্ভরশীল ছিল। নির্বাচন ঘিরে এই দেশটির কাছ থেকে যেমনটি আশা করেছিল তা পূরণ হয়নি। বরং নির্বাচনের পর তাদের কার্যক্রমে চরম হতাশ বিএনপি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন কোনো কৌশলে নির্ধাণেরও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

এছাড়া অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তারা। প্রতিবেশী ভারত বিরোধিতার কৌশল নেওয়ার ক্ষেত্রে একবার এগুচ্ছে তো আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। চীনসহ পূর্বমুখী ক‚টনীতির দিকেও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও কার্যকরী কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়। সবমিলে ক‚টনৈতিক তৎপরতায় বিএনপি কোনো পথে এগোবে এ নিয়েও দলের অভ্যন্তরে নানা জটিলতা রয়েছে।

জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সফর নতুন কোনো বার্তা আসে কিনা তা নিয়েও আশায় ছিল বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিন্তু এই সফরে আশা সফল হওয়ার মতো কোনো বিষয় দৃশ্যমান না হওয়ার পাশাপাশি শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে কর্মীরা হতাশা হয়েছেন।

এই সফরের বিষয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলি, বাংলাদেশে জনগণ কারও ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনবে, এটা আমরা মনে করি না।’

সূত্রমতে, আন্দোলনের মতো বিএনপির ক‚টনৈতিক তৎপরতা চলছে নামকাওয়াস্তে। প্রতিবেশী ভারতের চলমান লোকসভা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকেও বিশেষ নজর রাখছে দলটি। আর ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের ক‚টনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় করার মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে।

আন্দোলন ও কূটনৈতিক তৎপরতার মতো সংগঠন শক্তিশালী করার বিষয়েও কার্যকরী উদ্যোগ নেই বিএনপিতে। লবিং, তদবির, পদ বানিজ্যের অভিযোগের মধ্যদিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তৃনমুলে দলটির কতটা শক্তিশালী অবস্থানে আছে তা ফুটে উঠেছে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। শোকজ, বহিষ্কার করেও নির্বাচন থেকে নেতাকর্মীদের বিরত রাখতে পারেনি তারা। এছাড়া নেতৃত্ব সংকট কাটাতে জাতীয় কাউন্সিলের চাপ থাকলেও এর কোন উদ্যোগ নেই। জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করে সংগঠনকে গতিশীল করার উদ্যোগও অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে।

সূত্রমতে, দেশে এখনই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে যাবে-বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও এমন ভাবছেন না। এজন্য দলকে শক্তিশালী করার প্রতি গুরুত্বের কথা বললেও কার্যকরী উদ্যোগ নেই। এখনই জাতীয় কাউন্সিল করার কোনো ভাবনা নেই। তবে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ও অঙ্গ সংগঠনগুলো পুনর্গঠন, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিশেষ করে দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে ত্যাগী নেতাদের পদায়নের চিন্তাভাবনা চলছে। এসব পদের জন্য ছাত্রদলের সাবেক কিছু নেতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

দল পুনর্গঠনের কার্যক্রমের বিষয়ে বিএনপির ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ‘তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়াতে এবং জনগণকে সংগঠিত করতে সারা দেশে কর্মিসভা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের কাছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।’

বিএনপি সূত্রমতে, দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কর্মকাÐের পাশাপাশি মিত্র রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং লক্ষ্য অর্র্জন না পর্যন্ত তা ধরে রাখার চাপ আছে বিএনপতে। তবে তা পর্যাপ্ত নয় বলেও মিত্রদের মধ্যে আলোচনা আছে।

জানা গেছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে থাকলেও বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশ আছে সমমনা দলগুলোতে। এসব দল ও জোটের সঙ্গে ঐক্য নিয়েও বিএনপিতে আছে মতানৈক্য। বিএনপির অনেকেই মনে করেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম তৈরি করা উচিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন, পুরনো ২০ দল বা জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঐক্য পুনর্বিন্যাস করা উচিত। আবার নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ ‘একলা চলো নীতি’ অবলম্বনের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। এ অবস্থায় গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলগুলোর নেতারা রয়েছেন ধোঁয়াশায়। এসব সংকট নিরসনে সরকারবিরোধী আগামী কর্মসূচি নিয়ে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি।

ইতোমধ্যে বিএনপি ১২ দলীয় জোট, সমমনা জোট, এলডিপি, লেবার পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যে, গণতন্ত্র মঞ্চ ও গণফোরামের সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়েছে।

কার্যকরী কোনো আন্দোলন না থকেলেও গণধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নূর জানান, রাষ্ট্র সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত তাদের যুগপৎ আন্দোলন চলমান থাকবে।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে