শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আমেরিকা-চীন টানাপড়েন

পরিস্থিতি বদলের সম্ভাবনা ক্ষীণ

অতীতে, যখন সম্পর্ক বড় ধরনের টালমাটাল অবস্থায় পড়েছিল, যেমনটা ১৯৮৯ সালে তিয়ানআনমেনে হত্যাযজ্ঞ কিংবা ১৯৯৫-৯৬ সালে তাইওয়ান প্রণালি সংকটের সময় হয়েছিল, দুই দেশই সম্পর্ক ফের স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এখন সন্দেহের স্তর গভীর, তিক্ত। প্রায় সব আলোচনাতেই একে অপরের দিকে আঙুল তুলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অর্থপূর্ণ মেলামেশার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

আমেরিকার একটি যুদ্ধবিমান সন্দেহভাজন চীনা গোয়েন্দা বেলুনকে গুলি করে ভূপাতিত করার পর গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরাশক্তির মধ্যে জমে থাকা মেঘ সরাতে এ বিষয় নিয়ে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা করছেন। পাঁচ সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ওই কথোপকথন এখনো হয়নি। উল্টো, বেলুন-কান্ডকে ঘিরে দুই মাসের কূটনৈতিক টানাপড়েন আর গত সপ্তাহে মস্কোতে শি জিনপিংয়ের সফর আমেরিকা-চীন সম্পর্কের ফাটল যে আরও চওড়া হয়েছে, তাই দেখাচ্ছে। কারও কারও মতে, ১৯৭০-এর দশকে বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে এতটা দূরত্ব আর কখনোই তৈরি হয়নি।

এপ্রিলের শুরুর দিকে আমেরিকায় তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের যাত্রাবিরতি পরিস্থিতিকে আরও জটিলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। লাতিন আমেরিকা থেকে ফেরার পথে ক্যালিফোর্নিয়ায় নেওয়া এই যাত্রাবিরতিতে সাই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান স্পিকার কেভিন ম্যাককার্থির সঙ্গে দেখাও করতে পারেন, এই পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত একাধিক সূত্র এ কথা জানিয়েছেন।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়নিজ স্টাডিজের অধ্যাপক উইলিয়াম হার্ভে বলেন, 'আমেরিকার কূটনীতিতে এটা মোটেও ভালো সময় নয়। শেষবার চীন ও রাশিয়া এতটা কাছে এসেছিল ১৯৫৭ সালে। যখন মাও জে দং মস্কোয় ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'পূবের বাতাস পশ্চিমা বাতাসকে হারিয়ে দেবে'। শি জিনপিং এবার মস্কো সফরে যাওয়ার পর রাশিয়া-চীন উভয় দেশ একসঙ্গে আমেরিকার নিন্দা করেছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা এখন ভাবছেন, কী করে বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে। বাইডেন-শি জিনপিং ফোনালাপ তার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। এই ফোনালাপ হলে, তা হবে গত বছরের নভেম্বর বালির জি-২০ সম্মেলনে বৈঠকের পর দুই নেতার প্রথম সরাসরি কথোপকথন। কিন্তু মার্কিন কূটনীতিকদের তুমুল আগ্রহ ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীন এ ধরনের ফোনালাপের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে জানা গেছে।

দুই প্রেসিডেন্টের দেখা-সাক্ষাৎ বা কথা না হলেও গত মাসে বেলুন-কান্ডের পর মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংকেনের সঙ্গে চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই-র বৈঠক হয়েছে, কিন্তু এতেও উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি।

বাইডেন প্রশাসনের শুরুর দিকে আলাস্কায় বৈঠকের পর মিউনিখের ওই বৈঠকের মতো আমেরিকা-চীনের আর কোনো বৈঠকে এত বৈরিতা দেখা যায়নি বলে বৈঠক সম্পর্কে অবগত একজন জানিয়েছেন। তিনি জানান, চীন ওই বৈঠকে বসার ব্যাপারেও খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বাধ্য হয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া-বিষয়ক শীর্ষ কূটনীতিক ডেনিয়েল ক্রিটেনব্রিঙ্ক নিজে ওয়াং ই-র পেছন পেছন সম্মেলনের কেন্দ্রস্থলে দৌড়ে যান এবং কখন বৈঠক হবে, তা জানতে চান।

স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন বক্তব্য

গত ৪ ফেব্রম্নয়ারি চীনের বেলুনকে গুলি করে ভূপাতিত করার মার্কিন সিদ্ধান্তে বেইজিংয়ের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ওয়াং ই বেলুন নিয়ে আমেরিকার প্রতিক্রিয়াকে 'উন্মাদনা' বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন।

এর তিন দিন পর বাইডেনের দেওয়া 'স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন' ভাষণও বেইজিং-ওয়াশিংটন তিক্ততা আরও বাড়িয়ে তোলে; ওই ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বমঞ্চে শি জিনপিংয়ের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যা চীনের কর্মকর্তাদের ক্ষেপিয়ে দেয় বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

চীন তাদের দেশের ভেতর ও বাইরে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে ভাষণে বাইডেন বলেছিলেন, 'একজন বিশ্বনেতার নাম বলুন, যিনি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে জায়গা বদল করবেন। একজনের নাম বলুন।' এসব বিষয়ে বার্তা সংস্থা 'রয়টার্স' ওয়াশিংটনে অবস্থিত চীন দূতাবাসের মন্তব্য চাইলেও তারা সাড়া দেননি।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রও মিউনিখের বৈঠক বা বাইডেনের মন্তব্য ঘিরে চীনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেছেন, চীনের সঙ্গে আমেরিকার যোগাযোগের 'খোলামেলা ও গঠনমূলক লাইন' চালু রাখবে।

কুইন্সি ইন্সটিটিউটের চীন বিশেষজ্ঞ মাইকেল সোয়াইন বলেন, 'অতীতে, যখন সম্পর্ক বড় ধরনের টালমাটাল অবস্থায় পড়েছিল, যেমনটা ১৯৮৯ সালে তিয়ানআনমেনে হত্যাযজ্ঞ কিংবা ১৯৯৫-৯৬ সালে তাইওয়ান প্রণালি সংকটের সময় হয়েছিল, দুই দেশই সম্পর্ক ফের স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এখন সন্দেহের স্তর গভীর, তিক্ত। প্রায় সব আলোচনাতেই একে অপরের দিকে আঙুল তুলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অর্থপূর্ণ মেলামেশার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

মার্কিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গত ২০ মার্চ বলেছেন, সাই ইং-ওয়েনের পূর্বনির্ধারিত যাত্রাবিরতি সত্ত্বেও চীন যেন যোগাযোগের চ্যানেলগুলো খোলা রাখে, সে জন্য বেইজিংয়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ওয়াশিংটন।

চীন স্বশাসিত তাইওয়ানকে তার নিজের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ দাবি করে, যে কারণে আমেরিকায় তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের যাত্রাবিরতি তাদের কাছে বেশ সংবেদনশীল বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হবে।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তারা জিনপিং-বাইডেন ফোনালাপ কিংবা বেলুন-কান্ডের সময় স্থগিত হওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিস্নংকেনের চীন সফরের সময়সূচি পুনর্নির্ধারণ, যে কোনো বিষয়ে চীনের সম্মতির অপেক্ষায় আছেন।

তাইওয়ান, চীন ও মঙ্গোলিয়া-বিষয়ক মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিক ওয়াটার্স এখন চীনে অবস্থান করছেন, সেখানে তিনি বিস্নংকেনের সফরের ভিত গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত একজন জানিয়েছেন।

আত্মবিশ্বাসী চীন

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের চীন-সংক্রান্ত সিলেক্ট কমিটির রিপাবলিকান চেয়ারম্যান মাইক গালাহারের মতো অনেকে আবার বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ চান। তাদের ভাষ্য, চীন ও রাশিয়া এরই মধ্যে 'নতুন স্নায়ু?যুদ্ধে' জড়িয়ে গেছে।

মাইক গালাহার বলেন, চীন যেন রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাইওয়ানে আক্রমণ করে না বসে, তা নিশ্চিতে ওয়াশিংটনের উচিত 'আগ্রাসী হয়ে তাইওয়ানে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র বিক্রিতে থাকা সব বাধা তুলে নেওয়া এবং স্বশাসিত দ্বীপটির গণতন্ত্র গিলে খেতে শি জিনপিংয়ের যে উচ্চাশা, তা প্রতিরোধে আমেরিকার শক্তি যে সক্ষম তা নিশ্চিত করা।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফেলো লিলি ম্যাকএলি বলেন, তবে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফোনালাপে বাইডেন এখন চীনের প্রেসিডেন্টকে বেশ সাহসী আর শক্তিশালী অবস্থানেই দেখতে পেতে পারেন, কেননা এরই মধ্যেই তিনি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করে ফেলেছেন, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকও সেরেছেন। যে কারণে শি জিনপিংয়ের ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকতে পারে, যে 'ছাড়' শুভেচ্ছা প্রকাশে অত্যন্ত জরুরি।

বারাক ওবামার আমলে পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার শীর্ষ কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করা ডেনিয়েল রাসেল বলেছেন, বাইডেন-জিনপিং ফোনালাপের জানালা 'খুলতে দেরি হতে পারে এবং দ্রম্নতই বন্ধ হয়ে যেতে পারে'। কেননা, কোয়াড দেশগুলোর সঙ্গে এবং জি-৭ এর বৈঠক করতে বাইডেন মে মাসে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া সফর করবেন; এসব জোটের মাধ্যমে ওয়াশিংটন চীনের আকাঙ্ক্ষা মোকাবিলায় অন্যদের সামনে এগিয়ে আসার উৎসাহ যুগিয়ে আসছে। ওই সফর চীনকে আরও তাতিয়ে দেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সংবাদসূত্র : রয়টার্স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে