ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ধন্নীপুর গ্রাম। গত কয়েক বছর ধরে এই গ্রাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কারণ সরকার এখানে মুসলমানদের জন্য একটা মসজিদ গড়ার জন্য জমি দিয়েছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেই জমিতে রামমন্দির নির্মাণ আর তার বদলে অন্য একটি জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি রামমন্দিরের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ধন্নীপুর গ্রামে মুসলমানদের জন্য পাঁচ একর জমি দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৯ সালের সেই রায়ের পরই খুব দ্রম্নতগতিতে যখন রামমন্দির গড়ে উঠেছে, তার উদ্বোধন ও নিয়মিত পূজাও চলছে, অন্যদিকে ধন্নীপুরে মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণ এখনো শুরুই হয়নি।
কোথায় ধন্নীপুর?
উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর-অযোধ্যা-লক্ষ্নৌ মহাসড়কে রৌনাহি থানার পাশ থেকেই শুরু হয় ধন্নীপুর গ্রাম। যে জমিটা মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়া হয়েছে, সেটা মহাসড়ক থেকে ২০০ মিটার দূরে। সেখানে পৌঁছিয়ে দেখা গেল, যে জমিতে টেন্ট (তাঁবু) ভাড়া দেন যারা, সে রকম কয়েকজন অনুষ্ঠান-বাড়ির শামিয়ানা শুকোতে দিয়েছেন। কৃষকরা তাদের গবাদি পশু চড়াচ্ছেন আর মাঠের মাঝখানে একটা দরগাহ নজরে এলো। জমি হাতে পাওয়ার প্রায় চার বছর পরও কোথাও কোনো নির্মাণকাজ চোখে পড়ল না। শুধু কয়েকটি জায়গায় সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে।
অন্যদিকে, অযোধ্যার রাম মন্দিরে 'প্রাণ প্রতিষ্ঠার' পর যে নির্মাণকাজ বাকি ছিল, তাও দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাম মন্দির নির্মাণে প্রায় ১৮০০ কোটি ভারতীয় টাকা খরচ হচ্ছে। মন্দিরে পৌঁছনোর জন্য রাম-পথ গড়া হয়ে গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে অযোধ্যাকে সাজিয়ে তোলার কাজও চলছে, তার জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।
অত্যাধুনিক নতুন বিমানবন্দর, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন গড়া হয়েছে। অযোধ্যার উন্নয়নের জন্য চলতি বছর কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০ কোটি ভারতীয় টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে আর আলাদাভাবে বিমানবন্দরের জন্য ১৫০ কোটি ভারতীয় টাকা দেওয়া হয়েছে।
দুই ধর্মের দুই উপাসনা-স্থলের ফারাকটা খুব চোখে পড়ছে। মসজিদ নির্মাণের জন্য যে ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে, তার সচিব আতাহার হুসেন বলছিলেন, 'দুটোর মধ্যে তুল না চলে না। রাম মন্দিরের জন্য নির্মাণকাজ, পাথর খোদাই ইত্যাদি তো দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। এ ছাড়া রামমন্দির গড়ে তুলতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল।'
এত দূরে কে নামাজ পড়তে যাবে!
ধন্নীপুর গ্রামের মানুষজন মসজিদের ব্যাপারে মুখ খুলতে চাইলেন না। তবে একজন, মুহাম্মদ ইসলাম বলছিলেন, 'মসজিদের জন্য অনেকবার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। কিন্তু কাজ তো কিছু শুরু হয়নি। তিনি বলেন, আগে কমিটির সদস্যরা আসতেন ১৫ আগস্ট আর ২৬ জানুয়ারি জাতীয় পতাকা তুলতে। তবে এ বছর তারা কেউ আসেননি। আমরা গ্রামের লোকেরাই পতাকা তুলেছি।' তিনি এটাও বলছিলেন যে, যদি এখানে হাসপাতাল গড়া হতো, তাহলে এলাকার মানুষের লাভ হতো। প্রায় চার থেকে ছয় ঘণ্টা যাত্রা করে লক্ষ্নৌ যেতে হতো না।
'অল ইনডিয়া মিলিস্ন কাউন্সিলে'র মহাসচিব খালেক আহমদ খান বলেন, 'জমিটা দেওয়া হয়েছিল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে। তাদের দায়িত্ব ছিল নির্মাণকাজ শুরু করা। যদি বাবরি মসজিদ মামলার মুসলমান পক্ষকে অথবা স্থানীয় মানুষকে দেওয়া হতো, তাহলে এতদিনে মসজিদ তৈরি হয়ে যেত। মসজিদ গড়ার কথা ছিল, যারা বাবরি মসজিদে নামাজ পড়তেন, তাদের জন্য। এতদূরে কে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে আসবেন!'
বাবরি মসজিদ মামলার অন্যতম পক্ষ ইকবাল আনসারি চলতি বছরের গোড়ার দিকে মসজিদের কাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'ওয়াকফ বোর্ড জমিটা নিয়ে নিল। তবে কাজ শুরু করার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি তারা। যতদিন মসজিদ অযোধ্যায় ছিল, ততদিন আমরা দেখাশোনা করতাম।'
অর্থের অভাবে নির্মাণ শুরু হয়নি
'ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনে'র সভাপতি জাফর ফারুকি বলেন, অর্থের অভাবে এখনো নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। অর্থ জোগাড় করার জন্য একটা কমিটিও হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সেটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটি সঠিকভাবে কাজ করছিল না বলে জানিয়েছে ফাউন্ডেশন। তবে ওই কমিটিরই এক সদস্য হাজি আরাফাত শেখের ওপর এখন অর্থ জোগাড়ের দায়িত্ব পড়েছে।
অযোধ্যায় 'টাইমস অফ ইনডিয়া'র সাংবাদিক আর্শাদ আফজাল খান বলেন, ট্রাস্টের উচিত ছিল কাজ শুরু করে দেওয়া। তারপর তারা মানুষের কাছে চাঁদা দেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারত।' তবে মানুষের উৎসাহে যে কিছুটা ভাটা পড়েছে, সেটাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ