গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই প্রবল হামলা চালিয়ে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখলে নিয়েছিল বিদ্রোহীরা। এরপর থেকে একের পর এক এলাকা হাতছাড়া হচ্ছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের। সবশেষ জর্ডান সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়ার দারা অঞ্চলও দখলে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। বলা চলে, এর মধ্যদিয়ে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল প্রায় পুরোটাই বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেল। এই দারা অঞ্চল থেকেই ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শুরু হয়েছিল। পরে রাশিয়া-ইরানের সাহায্যে অঞ্চলটি উদ্ধার করেছিল বাশার সরকার। বিদ্রোহীদের হাতে হোমসের উত্তরে হামা দখল প্রেসিডেন্ট আসাদের জন্য দ্বিতীয় বড় ধাক্কা। গত সপ্তাহেই আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন বাশার। তথ্যসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স
যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি যুদ্ধ মনিটর রিপোর্ট করেছে, স্থানীয় সশস্ত্র দলগুলো সরকারি বাহিনীর সঙ্গে প্রবল যুদ্ধের পর দারায় অনেক সামরিক স্থানের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে। বিদ্রোহী সূত্রগুলো বলছেন, তারা সিরিয়ার সেনাবাহিনী এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সরে যেতে রাজধানী দামেস্ক থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) দূরে একটি নিরাপদ রাস্তা দেওয়ার চুক্তিতে পৌঁছেছে। দাবি করা হচ্ছে, উত্তর সিরিয়ার ইসলামপন্থি নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা হোমস শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছেছে। তবে এই তথ্য যাচাই করা যায়নি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) বলেছে, দক্ষিণের বিদ্রোহীরা দারা অঞ্চলের ৯০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং শুধু সানামাইন এলাকা এখনো সরকারের হাতে রয়েছে।
দারা শহরের কৌশলগত এবং প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে। এটি একটি প্রাদেশিক রাজধানী এবং জর্ডানের সীমান্তের প্রধান ক্রসিংগুলোর কাছাকাছি। এই প্রদেশটি রাজধানী দামেস্কের নিকটবর্তী। এছাড়া এখান থেকেই ২০১১ সালে গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। যা একপর্যায়ে দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধের জন্ম দেয়। এতে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
জর্ডানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, দক্ষিণ সিরিয়া পরিস্থিতি অবনতির কারণে দেশটির সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে। আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের পর জর্ডান, রাশিয়াও সিরিয়া থেকে তার নাগরিকদের দ্রম্নত দেশে ফিরতে নির্দেশনা দিয়েছে।
এদিকে, দারার প্রায় ৫০ কিলোমিটার পূর্বে সুওয়েইদা শহরের সরকারি কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে প্রধান সংখ্যালঘু দ্রম্নজ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বাহিনী এবং মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘর্ষের পর শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। 'সুওয়েইদা টোয়েন্টি ফোর ডটকমে'র সম্পাদক রায়ান মারুফ বলেন, সিরিয়ার বাকি অংশে যা ঘটছে, তা সিরিয়ার সরকারের পতনের সুযোগ হিসেবে দেখছে মানুষ।
ওদিকে, কুর্দি-নেতৃত্বাধীন বাহিনী বলেছে, তারা দেশটির পূর্বে বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে সরকারের প্রধান পদস্থল দেইর আজ-জৌর শহর দখল করেছে। সুন্নি বিদ্রোহীরা কৌশলগত শহর হোমসের উপকণ্ঠে পৌঁছেছে। সিরিয়ার সামরিক বাহিনী ও রাশিয়ান মিত্ররা পাল্টা লড়াই করছে। শুক্রবার শহরের উপকণ্ঠে বিমান হামলায় ২০ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।
বিদ্রোহী আক্রমণের ফলে এ পর্যন্ত অন্তত তিন লাখ ৭০ হাজার মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, নতুন এই যুদ্ধ দেশের উত্তরে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে। কিছু বেসামরিক নাগরিক সামনের সারির এলাকায় আটকা পড়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে পারছে না।
এসওএইচআর বলেছে, গত সপ্তাহে ইসলামপন্থি নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা তাদের আক্রমণ শুরু করার পর থেকে ১১১ জন বেসামরিক নাগরিকসহ ৮২০ জনের বেশি লোক সারাদেশে নিহত হয়েছেন।
ইসলামী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি হোমসের বাসিন্দাদের বলেছেন, 'আপনার সময় এসেছে। বিদ্রোহীরা দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছে এবং হোমস হবে দামেস্কের রাস্তার পরবর্তী স্টপ।'
গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো- বিদ্রোহীদের হামলার মুখে প্রেসিডেন্ট বাশারের অন্য প্রধান মিত্র ইরান তার সামরিক কমান্ডার এবং কর্মীদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট বাশারের আলাউয়ি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে হোমস ছেড়ে যাওয়ার জন্য ছুটছেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, প্রধানসহ অলিগলির সড়কেও যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। আলাউয়িরা শিয়া মুসলিমদের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বাশার পরিবার এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত।
হামলার নেতৃত্বদানকারী সিরিয়ান দল 'টেলিগ্রা'ম চ্যানেলে বলেছে, 'আমাদের বাহিনী হোমস শহরের উপকণ্ঠে শেষ গ্রামটি মুক্ত করেছে।' এসওএইচআর বলেছে, রুশ যুদ্ধবিমান বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রাকে ধীর করে দিতে নিকটবর্তী রাস্তান এলাকায় একটি সেতুতে বোমা হামলা করেছে। কয়েকদিনের যুদ্ধের পর সিরিয়ার সামরিক বাহিনী হামার নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর, তারা হোমসকে রক্ষা করতে পারবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
এদিকে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। একইসঙ্গে পশ্চিমা শক্তিগুলোকে এই অঞ্চলের মানচিত্র বদলে দেওয়ার চেষ্টার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
গত ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। সেখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি পক্ষ। ২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিয়েছিল আমেরিকা।