ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে দৌড়ঝাপ। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স এই যুদ্ধ বন্ধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সম্ভাবনা নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখো ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার হোয়াইট হাউজে আলোচনা করেন। তবে যুদ্ধ বন্ধের উপায় নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য কাটেনি। ম্যাখো হচ্ছেন প্রথম ইউরোপীয় নেতা যিনি এক মাস আগে ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্পের সঙ্গে এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের বৈঠক করেন। এই বৈঠকে উভয় নেতা ইউক্রেন নিয়ে জি-৭ নেতাদের সঙ্গে একটি ভিডিও কনফারেন্সেও অংশ নেন। হোয়াইট হাউজ থেকে বেস্নয়ার হাউজ গেস্ট রেসিডেন্সে ফেরার পথে ম্যাখো বলেন, ট্রাম্পের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা খুব ভালো ও খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা ওভাল অফিসে জি৭-এর নেতাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছি। দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও এই সপ্তাহের শেষের দিকে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ইউক্রেনের প্রতি ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান এবং তিন বছরের ইউক্রেন সংঘাতে মস্কোর প্রতি তার আগ্রহ নিয়ে ইউরোপে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত বুধবার যুদ্ধকালীন সহায়তার জন্য ওয়াশিংটনের কাছে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এই পরিমাণ অর্থ সরবরাহ করেনি এবং চুক্তিতে কোনও নির্দিষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেয়নি। ম্যাখো তাদের প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল মেয়াদে গড়ে ওঠা সম্পর্কের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, একটি খারাপ চুক্তিতে সম্মত হওয়া ইউক্রেনের আত্মসমর্পণের সমান হবে এবং চীন ও ইরানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের শত্রম্নদের দুর্বলতার ইঙ্গিত দেবে। ইউক্রেন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে অনেক বিষয়েই একমত হতে পারেননি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখে। সোমবারের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে দুই নেতার মধ্যে মতভেদ আরও প্রকটভাবে প্রকাশ পায়।
সাংবাদিক সম্মেলনে ম্যাখো বলেন, আমরা যুদ্ধ বন্ধ করতে দ্রম্নত চুক্তি চাই। তবে সেই চুক্তি ভঙ্গুর হলে চলবে না। আর শান্তি মানে এই নয় যে, ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ম্যাখো বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করা ভালো। কিন্তু পুতিনের দাবি মেনে ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাই প্রকট হবে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের মতে, ইউক্রেনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়া যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। ট্রাম্প এই নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিশ্চয়তা নিয়ে একটা কথাও বলেননি। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি দ্রম্নত এই যুদ্ধ বন্ধ করতে চান। তবে মাখো বলেন, আমরাও চাই যুদ্ধ দ্রম্নত বন্ধ হোক। কিন্তু আমরা এমন চুক্তি চাই না, যা দুর্বল। তবে দুই নেতা একটা বিষয়ে একমত, তা হলো, যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর ইউক্রেনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শান্তিরক্ষী বাহিনী থাকবে। মাখো বলেছেন, শান্তিরক্ষীরা সীমান্তে থাকবে না। তারা শুধু ইউক্রেনে শান্তি বজার রাখায় ভূমিকা রাখবে। ইউক্রেন ইইউয়ের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে ট্রাম্প বলেছেন, আমি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন, এটা নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এখন আলোচনা শুরু হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে কি আর নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসাবে ভাবা ঠিক হবে? ট্রাম্প যেভাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন ও তিনি যেভাবে বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন মাত্রা আসতে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে সাহায্য করা নিয়ে ট্রাম্পের দাবি খারিজ করে দিয়েছেন ম্যাখো। ট্রাম্পের দাবি ছিল, ইউরোপ ইউক্রেনকে ঋণ দিয়েছে। তারা পরে অর্থ ফেরত পেয়ে যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতো ইউক্রেনকে শুধু অর্থ ও সামরিক সাহায্য করে গেছে। সেই সময় ম্যাখো বলেন, এই তথ্য ঠিক নয়। আমরাও ইউক্রেনকে অর্থ দিয়েছি। আমরা ইউক্রেনকে যে অর্থ দিয়েছি, তার ৬০ শতাংশ হলো তাদের সাহায্য করতে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইইউ-ও ইউক্রেনকে ঋণ, গ্যারান্টি ও অনুদান দিয়েছে।
এ দিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের পেশ করা একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দ্রম্নতই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে ১০ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পাঁচটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। রাশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো এই প্রস্তাবে কিছু সংশোধনী এনেছিল। তবে তা খারিজ হয়ে যায়। তিন বছর আগে ইউক্রেনে 'সামরিক অভিযান' শরু করে রাশিয়া। যুদ্ধের তৃতীয় বার্ষিকী পালনে কিয়েভে গিয়েছেন কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা। ট্রাম্প বলেছেন তিনি যত দ্রম্নত সম্ভব একটি যুদ্ধবিরতি চেয়েছেন এবং এতে একমত হলে তিনি রাশিয়া সফরে গিয়ে ভস্নাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে গত সপ্তাহে সৌদি আরবে বৈঠকের পর এই সপ্তাহে আবারও বৈঠকে বসতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। সোমবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এই তথ্য জানিয়েছেন। তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, আঙ্কারায় তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। সেখানে
\হল্যাভরভ বলেন, চলতি সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবারও বৈঠক করবে রাশিয়া। কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনায় যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেসব বিষয় এবারের বৈঠকে গুরুত্ব পাবে। গত সপ্তাহে সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ফলাফলও তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিদানের কাছে তুলে ধরেন ল্যাভরভ। তিনি সংবাদিকদের বলেন, গত ১৮ ফেব্রম্নয়ারি রিয়াদে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা আমরা আমাদের তুর্কি বন্ধুদেরকে কাছে বিস্তারিতভাবে শেয়ার করেছি। ওই আলোচনা একটি স্বাভাবিক সংলাপের সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। যদিও এতে অনেক বিরোধিতা অব্যাহত রয়েছে।' ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করা প্রসঙ্গে ল্যাভরভ বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে ইউক্রেন, ইউরোপ এবং অন্য যে কোনো পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে মস্কো প্রস্তুত রয়ছে। তবে এ যুদ্ধ তখনই বন্ধ হবে যখন মস্কোর জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান মিলবে। রাশিয়ার এই শীর্ষ কূটনীতিক দাবী করেন, এর আগে বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া, কিন্তু ইউক্রেন সেই আহ্বানে কখনোই সাড়া দেয়নি। ল্যাভরভ আরও বলেন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অবশ্যই তাকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সূত্র: আনাদোলু