পবিত্র রমজান মাসে গাজায় তীব্র খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে সব ধরণের মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দেয়ায় এই আশংকা দেখা দিয়েছে। জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দারা সতর্ক করে বলেছেন, মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ফলে দুর্ভিক্ষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশ ইসরাইলের এই সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। মিশর, কাতার ও জর্ডান এটিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের সময়সীমা বাড়ানোর ইসরাইলি দাবিকে প্রত্যাখ্যান করায় হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ইসরাইল। শনিবার ওই চুক্তির প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার পর ইসরাইল মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। হামাস ইসরাইলের এই শর্তকে 'চাপ প্রয়োগের কৌশল' আখ্যা দিয়ে বলেছে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করতেই হবে। এদিকে গাজা উপত্যকায় সব ধরনের ত্রাণ ও মানবিক সহায়তার প্রবেশ বন্ধ করার জন্য ইসরাইলের কঠোর সমালোচনা করেছে কয়েকটি আরব রাষ্ট্র ও জাতিসংঘ। মিশর ও কাতার রোববার ইসরাইল এই পদক্ষেপকে অস্ত্রবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। আর জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার এটিকে 'উদ্বেগজনক' বলেছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে। রোববার এক বিবৃতিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরাইলের সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি 'অস্ত্রবিরতি চুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন'। সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরাইলকে 'ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে' বলে অভিযুক্ত করেছে।' কাতার ও মিশর গাজার অস্ত্রবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিল। সৌদি আরবও ইসরায়েলের মানবিক সহায়তা অবরোধের 'নিন্দা ও প্রতিবাদ' জানিয়েছে বলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। জাতিসংঘের আন্ডার-সেক্রেটারি-জেনারেল ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স টম ফ্লেচার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, 'আন্তর্জাতিক মানবিক আইন স্পষ্ট: আমাদের প্রাণরক্ষাকারী সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ দিতে হবে।' ইসরাইলেরর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন যে হামাস এই সহায়তা লুট করছে এবং সেগুলো 'সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার করছে'। তিনি আরও অভিযোগ করেছেন যে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীটি গাজায় অস্ত্রবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, যদিও ইসরাইল ওই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। হামাস আগেও গাজায় মানবিক সহায়তা লুট করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হামাসের এক মুখপাত্র ইসরাইলের অবরোধকে 'সস্তা বস্ন্যাকমেইল' এবং অস্ত্রবিরতি চুক্তির বিরুদ্ধে 'অভু্যত্থান' বলে অভিহিত করেছেন। এই অস্ত্রবিরতি চুক্তির ফলে ১৫ মাস ধরে চলা হামাস ও ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ বন্ধ হয়েছিল। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৩৩ জন ইসরাইলি বন্দির বিনিময়ে প্রায় ১,৯০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামাসকে আরও কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ইসরাইলি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সরকার গাজায় পানি ও বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) বলেছে, গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধ করা ইসরাইলি নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রমাণ আরও শক্তিশালী করবে। সংগঠনটি নেতানিয়াহুকে 'অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী' বলে উলেস্নখ করে বলেছে, রমজান মাসে গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা বন্ধ করা স্পষ্টতই একটি যুদ্ধাপরাধ এবং ইসরাইলের গণহত্যার ইচ্ছার আরেকটি প্রমাণ। আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশন সতর্ক করেছে, ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের আবারও চরম সংকটের মধ্যে ফেলেছে। গাজায় নিরাপদ ও বাধাহীনভাবে মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানিয়েছে তারা। মানবাধিকার সংস্থা অ্যাকশন ফর হিউম্যানিটি ইসরাইলের এই পদক্ষেপকে 'গণযন্ত্রণা' হিসেবে বর্ণনা করে বলেছে, এটি নিষ্ঠুরতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এটি পরিকল্পিত, কাঠামোবদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল বলেছে, ইসরাইলের নতুন অবরোধ গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে ধ্বংসের একেবারে শেষ সীমায় ঠেলে দেবে। সংস্থাটি ইসরাইলকে অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের সেহেরি-ইফতার করতে হচ্ছে। অনেকের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে তাদের দুসহ জীবন যাপনের কথা। 'আমরা গভীরভাবে শোকাহত এবং আমাদের চারপাশের সবকিছু হৃদয়বিদারক। তাই আমরা এ রাস্তায় আনন্দ ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঠিক যেমনটি যুদ্ধের আগে ছিল'। কথাগুলো বলেছিলেন দক্ষিণ গাজায় ধ্বংসস্তূপের কাছে ইফতার আয়োজনকারী মালাক ফাদ্দা। তিনিই সম্মিলিত খাবারের আয়োজন করেছিলেন। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটার পর শনিবার এভাবেই দক্ষিণ গাজায় ধ্বংসস্তূপের ওপর ইফতার করেন সেখানকার ক্ষতিগ্রস্তরা। রাফাহ শহরের একটি এলাকায় সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন পরিবেশে ইফতার করেন অনেক মানুষ। ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যুদ্ধের ফলে ওই এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে। সব বয়সের শত শত গাজার মানুষ সারাদিন রোজা শেষে ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে টেবিল সাজিয়ে তাদের ইফতারের খাবারে অংশ নেন। সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি ও আল আরাবিয়া নিউজ