আমি বিভিন্ন লেখক এবং গবেষকের উদ্ভাবিত বেশ কিছু জনপ্রিয় প্যারেন্টিংয়ের ধরন সম্পর্কে জেনেছি এবং অনেক বাবা-মা'ও শিশুর সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। অনেক বাবা-মা এবং শিশুর জীবনপ্রণালি সম্পর্কে খুব কাছ থেকে জেনেছি, সেখান থেকে আমি যে ধারণটা উদ্ভাবন করেছি, সেটা আপনাদের কাছে উপস্থাপন করছি- স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিং হিসেবে।
স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিং :
ঝঃধরৎধিু ইংরেজি শব্দ যার বাংলা অর্থ সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি শব্দটির সঙ্গে সবাই পরিচিত। তবে সিঁড়ি বলতেই আমাদের মাথায় অবরোহণ শব্দটি আসে কিন্তু অরোহণ শব্দটা খুব একটা আসে না। কিন্তু সিঁড়ি হচ্ছে আরোহণ এবং অবরোহণ উভয়ের মাধ্যম।
স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিংয়ে বাবা-মা সন্তানের সিঁড়ি হিসেবে থাকেন। সন্তানকে ঠিক যেমন উন্নতিতে সহায়তা করেন ঠিক তেমন সন্তানের অবনতিতে তার পাশে থাকেন। সন্তানের সমস্যায় তাকে সেখান থেকে বিচু্যত করে নিয়ে আসতে অবরোহণের সিঁড়ি হিসেবে কাজ করেন বাবা-মা। আর তেমনি সন্তানের সফলতা সিঁড়ি হিসেবেও কাজ করেন।
আমি এ ধরনের প্যারেন্টিংয়ের সংখ্যা খুঁজে পেয়েছি হাতে গোনা। বেশিরভাগ বাবা-মা সন্তানের সফলতায় আরোহণের সিঁড়ি হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও সন্তানের ব্যর্থতায় সেখান থেকে অবরোহণে তাকে সহায়তা না করে হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছেন এমনকি সন্তানকে ঠিক ওই সময়টাতে অবহেলাও করছেন অনেক বাবা-মা- যার কারণে সেই সন্তান পরবর্তী সময়ে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও হারিয়ে ফেলছে।
স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিংয়ের বৈশিষ্ট্য :
* সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ।
* সন্তানের সফলতায় তাকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করা।
* সন্তানের কোনো বিষয়ে সমালোচনা না করা।
* সন্তানকে নিয়ে নিজে হতাশাগ্রস্ত না হওয়া এবং সন্তানকে হতাশ হতে না দেওয়া।
* সন্তানের ব্যর্থতায় তাকে আশ্বাস দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে সফলতার জন্য প্রস্তুত করা।
* সন্তানকে সব সময় নজরে রাখা।
* সন্তানের কোনো প্রকার অযোগ্যতাকে প্রশ্রয় না দেওয়া।
স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিংয়ের সুবিধা :
* সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক :
এখানে বাবা সন্তানের সফলতা ও ব্যর্থতায় সমানভাবে পাশে থাকেন। তাতে করে সন্তানের ভেতর কোনো ভীতি কাজ করে না যে কোনো কিছু নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে বাবা-মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
* হতাশাগ্রস্ত না হওয়া :
আমাদের শিশুরা ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে পড়ে এবং এটাই স্বাভাবিক আচরণ; সেক্ষেত্রে বাবা-মা পাশে থাকলে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয় না। সেখান থেকে খুব সহজে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়- যা পরবর্তী কাজে তাকে উৎফুলস্নতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
* অনুপ্রেরণা :
সন্তানের প্রতিটা সফলতায় বাবা-মায়ের সঙ্গ এবং অভ্যর্থনা সন্তানকে এতটাই অনুপ্রাণিত করে- যা তার পরবর্তী সব কাজে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।
* চ্যালেঞ্জ গ্রহণ :
আমাদের শিশুরা যখন বুঝতে পারে কোনো কাজের ফলাফল দুই রকম হয়- সফলতা ও ব্যর্থতা তখন থেকে তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আগে ভাবনায় পড়ে যায় কিন্তু স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিং বাবা-মা তাদের ব্যর্থতায়ও এদের আগলে রাখে বলে তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণে পিছিয়ে পড়ে না।
স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিংয়ের অসুবিধা :
* সফলতার হার ক্ষেত্রবিশেষে হ্রাস :
স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিংয়ে ব্যর্থতার ভয় কমে যাওয়ার কারণে সফলতার মাঝে মাঝে একটু ভাটা পড়ে- তাদের এটা মনেই হয় না যে, সফলতা অর্জন করতেই হবে। তারা সফলতা অথবা ব্যর্থতা যে কোনোটাই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে।
* প্রচেষ্টা তুলনামূলক কম :
তারা বাবা-মা'কে পাশে পাওয়ায় তাদের সফল হওয়ার প্রচেষ্টা তুলনামূলকভাবে কমে যায় অর্থাৎ তাদের ব্যর্থতা ভীতি কমে যাওয়ায় চেষ্টা করার প্রবণতাও কমে যায়। যেটা তাদের আত্মবিশ্বাস তৈরিকে কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত করে।
* নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি :
সব বিষয়ে শিশু বাবা-মা'র মানসিক সাপোর্ট পেতে পেতে সব বিষয়ে তাদের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের এই নির্ভরশীলতা পরবর্তী সময়ে তাদের আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠাকে সময়সাপেক্ষ করে তোলে।
* আত্মসমালোচনার সুযোগ হ্রাস :
যখন শিশু হঠাৎ পিছিয়ে পড়ে তখন হেলান দেওয়ার জন্য বাবা-মা'কে পেয়ে যায় বলে নিজের আত্মসমালোচনা করার সুযোগ পায় না। নিজের পিছিয়ে পড়ার কারণ নিজে নিজে বিশ্লেষণ করার তাগিদ অনুভব করে না।
আমার কাছে মনে হয়েছে আমার উদ্ভাবিত এই ধরনটি খুব কম সংখ্যক অভিভাবকের মধ্যে লক্ষণীয়- যা বেশিরভাগ বাবা-মা'য়ের মধ্যে দেখতে পারলে সন্তানদের অর্থাৎ আমাদের নতুন প্রজন্মের সফলতার হার বেড়ে যাবে। আমাদের শিশুদের হতাশামুক্ত একটা সুন্দর জীবন দিতে সক্ষম হবে স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিং স্টাইল। এই পদ্ধতি অনুসৃত বাবা-মা'য়েরা ইতিবাচক একটা প্রভাব নিয়ে আসতে পারবে সন্তানের জীবনে এবং হয়ে উঠতে পারবেন সফল বাবা-মা।
মুদ্রার যেমন এপিঠ-ওপিঠ রয়েছে, ঠিক তেমন সব বিষয়ের সুবিধা-অসুবিধা বিদ্যমান থাকাটাও স্বাভাবিক- তবে স্টেইরোয়ে প্যারেন্টিং মডেলের সুবিধা ও অসুবিধার আলোকে চিন্তা করলে এই মডেলটি ইতিবাচক একটি মডেল। আপাতদৃষ্টিতে এর কিছু অসুবিধা পরিলক্ষিত হলেও এগুলো শিশুর মানসিক বিকাশ খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
লেখক : সহকারী শিক্ষক
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।