শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

বঙ্গবন্ধু ও ভাস্কর্য

মুসলিম দেশগুলোতে ভাস্কর্য থাকলে, বাংলাদেশে থাকবে না কে? মূর্তি আর ভাস্কর্য এক কথা নয়। মূর্তি অনেকেই পূজা করে কিন্তু ভাস্কর্য কেউ পূজা করে না। ভাস্কর্য হচ্ছে একটি দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক, বীরত্বগাথার প্রতীক, ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে ত্যাগ বঙ্গবন্ধু করেছেন। তার ভাস্কর্য তো আগে থেকেই প্রতিটি জেলায় স্থাপন করা উচিত ছিল।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
বঙ্গবন্ধু ও ভাস্কর্য
বঙ্গবন্ধু ও ভাস্কর্য

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনাকে ইসলামের দৃষ্টিতে অনুচিত দাবি করেছেন হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতা। এ নিয়ে তারা হুমকিও দিয়েছেন। তাদের উস্কানিমূলক বক্তব্যে এরই মধ্যে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা উষ্কানি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে। ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে সারাদেশ সোচ্চার।

যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির ক্ষেত্রে বিরোধিতা করছেন তারা কি জানেন না বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে ভাস্কর্য রয়েছে। যেমন- তুরস্ক, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লেবানন। এমনকি আলজেরিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশে রয়েছে ভাস্কর্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এ সবের ওপর ভিত্তি করে নানা ধরনের ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যায় দেশটির সৌন্দর্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে বন্ধনের রেস, আরও কতকিছু! মুসলিম দেশগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। বহু মুসলিম দেশ আছে তারা তাদের সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে। ইসলামের পুণ্যময় ভূমি বলা হয়ে থাকে সৌদি আরবকে। ইসলাম ধর্মের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা এ দেশে অবস্থিত। রাজধানী জেদ্দার উলেস্নখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে নগরীতে মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাংরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য। আফগানিস্তানের জঙ্গিরাও হাত দেয়নি অষ্টম শতকের সমরনায়ক আবু মুসলিম খোরাসানির ভাস্কর্যের গায়ে। গজনীতে এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে সেই ভাস্কর্য। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মালয়েশিয়ার অবস্থান মুসলিম বিশ্বে ১৩তম। দুই কোটি ৮০ লাখের জনসংখ্যার দেশটির ৬০.৪ শতাংশ মানুষই মুসলিম। সেখানেও রয়েছে অনেক দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য হলো ওয়াশিংটন মনুমেন্টের আদলে গড়া ন্যাশনাল মনুমেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীরদের স্মরণে ১৫ মিটারের এ ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত করা হয় ১৬৬৩ সালে। পারস্য উপসাগরের দেশ কাতার। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি কাতার। কাতারেও দেখা যায় ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। কাতারের সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য ভাস্কর্য হলো 'হারনেসিং দ্য ওয়ার্ল্ড', মানে হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ।

১৯৭১ সালে ১৪ দিনের ব্যবধানে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ আর সংযুক্ত আরব আমিরাত। সংযুক্ত আরব আমিরাতের উলেস্নখযোগ্য ভাস্কর্য হলো আরবীয় যুগলের মূর্তি, দুবাইয়ের ওয়াফি অঞ্চলের প্রবেশপথে পাহারাদারের প্রতিমূর্তি হিসেবে সংস্থাপিত কুকুরের মূর্তি, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মার্কেটে স্থাপিত মূর্তি। তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। তার নেতৃত্বে খেলাফত শাসনের অবসান ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এক আধুনিক তুরস্কের যাত্রা শুরু হয়। তিনি আধুনিক তুরস্কের জনক। সারা তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্কের অগণিত ভাস্কর্য। ইসলামী স্বর্ণযুগের প্রতিভূ ইরাক। ইরাকেও আছে অনেক ভাস্কর্য। বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ডানার ভাস্কর্যটি সবার নজর কাড়ে। বাগদাদের পাশে আল-মনসুর শহরে আছে মনসুরের একটি বিশাল ভাস্কর্য। আছে অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্য। সাদ্দাম হোসেনের বিশাল আকারের ভাস্কর্য ছিল যেটি আর এখন নেই।

ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরান অন্যতম। পারস্যের ইতিহাসের সূচনা প্রায় এক লাখ বছর আগে থেকে। ইরানে আছে একটি বিশাল স্বাধীনতা স্তম্ভ, যার নাম 'আজাদি'। কবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহর মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে। সবচেয়ে বেশি মুসলিম অধু্যষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া। সেই দেশেরই উত্তর সুলাবেসি দ্বীপের খ্রিষ্টান অধু্যষিত শহর মানাদোতে রয়েছে যিশু খ্রিষ্টের এমন একটি ভাস্কর্য, যেটি এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু। এ ভাস্কর্য নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই ইন্দোনেশীয় মুসলমানদের। পিরামিডের জন্য দুনিয়াজোড়া খ্যাতি মিশরের। বিরাটত্বের দিক থেকে বিখ্যাত হলো জোসার বা স্টেপ (সোপান) পিরামিড ও গিজা পিরামিড। পাথরের তৈরি স্ফিংসের ভাস্কর্যসংবলিত গিজা পিরামিড সারা দুনিয়ার পর্যটকদের অতি প্রিয়। শুধু ইসলাম-পূর্বই নয়, অনেক অনেককাল আগের তথা খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার অব্দের এ সব ভাস্কর্য মিশরের মুসলমানরা ধ্বংস করেনি। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে মাহমুদ মোখতারের বিখ্যাত ভাস্কর্য 'ইজিপ্ট'স রেনেসাঁ'। এখানেই শেষ নয়। খোদ পাকিস্তানে রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্য। লাহোরে বাদশাহী মসজিদের পার্শ্বে মেরি মাতার ভাস্কর্য। পাঞ্জাবের জং শহরের রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড় সওয়ারের ভাস্কর্য। লাহোরে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস প্রাঙ্গণের নানা ভাস্কর্য। এতে বোঝা যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বও ভাস্কর্য শিল্প থেকে পৃথক নয়। যদি তাই হয়ে থাকে তা হলে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে কেন বিতর্ক উঠবে। আর কেনই বা তার ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হবে।

মুসলিম দেশগুলোতে ভাস্কর্য থাকলে, বাংলাদেশে থাকবে না কে? মূর্তি আর ভাস্কর্য এক কথা নয়। মূর্তি অনেকেই পূজা করে কিন্তু ভাস্কর্য কেউ পূজা করে না। ভাস্কর্য হচ্ছে একটি দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক, বীরত্বগাথার প্রতীক, ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে ত্যাগ বঙ্গবন্ধু করেছেন। তার ভাস্কর্য তো আগে থেকেই প্রতিটি জেলায় স্থাপন করা উচিত ছিল।

মনে রাখতে হবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বেই পরাধীন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তিনি বহুবার তার ভাষণে এবং লেখায় এ কথা ব্যক্ত করেন। দীর্ঘদিন জনমত গঠন করে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। অনেক ত্যাগ সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন কিংবদন্তি জননেতা। বিশ্ব সম্প্রদায় তার কারণেই বাংলাদেশকে চিনেছে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিন তার নাম কেউ মুছে দিতে পারবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা শব্দ দুটি সমার্থক। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মাধ্যমে এ দুটি নাম একসঙ্গে মিলে গেছে। বঙ্গবন্ধু মাত্র ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কেবল পাকিস্তান আমলেই ১৮ বার কারারুদ্ধ হয়ে ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন। ২৪টি মামলা তিনি সাহসের সঙ্গে লড়েছেন এবং দুইবার মৃতু্যর সামনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ফিরে এসেছেন। তিনিই প্রথম নেতা যিনি মাতৃভাষায় প্রথম জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষার মুখ উজ্জ্বল করেন। পৃথিবীর আর কোনো নেতা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছাড়া তার স্বভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন কিনা সে ইতিহাস আমাদের অজানা। বাংলা ভাষার সম্মানে পৃথিবীব্যাপী ২১ ফেব্রম্নয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। বাঙালি হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন সেটাও আজ ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বঐতিহ্যের অংশীদার। এরপরেও কি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের ভুল ভাঙবে না। তাকে নিয়ে বিতর্ক থামবে না। কেবল ঢাকায় কেন সারা দেশে তার ভাস্কর্য স্থাপন করতে হবে। যারা এর বিরোধিতা করবে, তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এ অপশক্তি মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে এ অশুভ শক্তির তৎপরতা ও ষড়যন্ত্রের আসল চেহারা ফুটে উঠেছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে ক্ষত-বিক্ষত করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। 'ভাস্কর্য ইসু্য জাতিকে বিভেদ, অনৈক্য ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো যে কোনো অপচেষ্টা প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন সব গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তিনি স্বাধীনতার প্রতীক। তার ভাস্কর্য সারা দেশে থাকবে এটাই বাস্তবতা। আশার কথা ভাস্কর্যবিরোধী অপতৎপরতা প্রতিহতে প্রশাসনের জোর নিরাপত্তা বলয়ের পাশাপাশি এখানকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অপতৎপরতাকে প্রতিহত করতে হবে।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে