ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চাতারা হাইস্কুলের শিক্ষক শ্রী নকুল চন্দ্র মলিস্নক সম্প্রতি বলেছেন, 'মুসলমানরা দেশ ভাগ চায়নি, সিদ্ধান্ত (ভারত ভাগের) নিয়েছিল কংগ্রেস (৭.১২.১২ মানব জমিন)।' শ্রী নকুল চন্দ্র মলিস্নক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ কথা বলেছেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ইউনিয়ন ও পাকিস্তান নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অখন্ড ভারত উপমহাদেশ খন্ডিত হয়েছে। রাষ্ট্র দুটির অভু্যদয়ের পর থেকেই ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির দায় কার তা নিয়ে রাজনীতিবিদ-রাজনীতি বিশ্লেষক, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনের মধ্যে নানা মত রয়েছে। এদের কেউ কেউ ভারত উপমহাদেশ ভাগের দায় মুসলিম সম্প্রদায় ও মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর, কেউ কেউ হিন্দু সম্প্রদায় ও কংগ্রেস নেতা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর ওপর চাপিয়েছেন। আবার কেউ কেউ এর দায় ইংরেজদের ওপরও চাপিয়েছেন। ভারত উপমহাদেশ ভাগের জন্য কে দায়ী সে বিতর্কের অবসান আজতক হয়নি, বিতর্ক আজো চলছে। ভারত উপমহাদেশ ভাগের জন্য হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়, কংগ্রেস-মুসলিম লীগ, পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু-মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ না ইংরেজরা দায়ী তা নির্মোহ মনোভাব নিয়ে ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই বেরিয়ে আসবে।
ভারত উপমহাদেশ ভাগের মূলে ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। দ্বিজাতি তত্ত্ব (হিন্দু-মুসলমান দুটো আলাদা জাতি তত্ত্ব) হিন্দু না মুসলমান সম্প্রদায়ের উদ্ভাবিত তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দ্বিজাতি তত্ত্ব ভারত উপমহাদেশ ভাগের মূলে তা নিয়ে কারো মধ্যে বিতর্ক নেই। দ্বিজাতি তত্ত্ব কার বা কাদের মস্তিষ্ক থেকে প্রথম এসেছিল তা জানলেই ভারত উপমহাদেশ ভাগের জন্য কে বা করা দায়ী সে প্রশ্নের উত্তর মিলবে। মুসলিম লীগ প্রধান মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর এ ঘোষণার বহু আগেই দ্বিজাতি তত্ত্ব আলোচিত বিষয় ছিল। প্রখ্যাত হিন্দু বুদ্ধিজীবী নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী 'এন অটো-বায়োগ্রাফি অব আননোন ইন্ডিয়ান' গ্রন্থে লিখেছেন, 'দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক মি. জিন্নাহ নন। মুসলিম লীগও নয়। এর জনক আমরা হিন্দুরাই, আমরাই সতীর্থ মুসলিম ছাত্রদের পাশাপাশি বসে ক্লাস করতে অস্বীকার করেছিলাম মুসলিম সতীর্থদের গা থেকে পিঁয়াজের গন্ধ বের হয়- আমরা তা সহ্য করতে পারি না বলে। তাই আমরা ক্লাসে পার্টিশন করিয়ে নিয়েছিলাম। দ্বিজাতি তত্ত্বের সূচনা সেখান থেকেই।' নিরোদ চন্দ্র চৌধুরীর এ উক্তি মতে, মুসলিম সম্প্রদায় নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ই দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই অকপটে স্বীকার করেছেন দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা হিন্দু সম্প্রদায়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এক গ্রন্থে লিখেছেন, ' হিন্দু-মুসলিম দুটি পৃথক জাতি'- এ ধারণার উপস্থাপক হিসেবে জিন্নাহকে দায়ী করা হলেও বাস্তব সত্য এই যে, জিন্নাহর বহু আগে ১৯২৩ সালে বিনায়ক দামোদর সাভাকার এই ধারণা উপস্থাপন করেন। তিনি ছিলেন এক উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা।' মি. সাভাকার এর পরও দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণা প্রচার করেছেন। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতি থাকাকালে সাভারকার বলেছেন, 'ভারতবর্ষকে আজ আর অভিভাজ্য ও সুসংহত জাতি মনে করে যায় না। এ দেশে দুটি জাতি হিন্দু ও মুসলমান।' কংগ্রেস নেতা সর্দার বলস্নভ ভাই প্যাটেলও ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানদের দুটি আলাদা জাতি মনে করতেন। সর্দার বলস্নভ ভাই প্যাটেল বলেছেন, 'আমরা চাই বা না চাই ভারতে দুটি জাতি। এ সত্য মেনে নেয়া ছাড়া গতি নাই।' সর্দার বলস্নভ ভাই প্যাটেলের এ উক্তি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার 'ভারত যখন স্বাধীন হলো' গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন। গত বছর ঢাকায় এশিয়াটিক সোসাইটিতে অনুষ্ঠিত 'লুকিং ইন টু দ্য পাস্ট ফর এ ফিউচার: শেয়ার্ড হিস্টোরি অব ইন্ডিয়াস নর্থ ইস্ট উইথ বাংলাদেশ' শীর্ষক সেমিনারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেছেন, 'ভারত ভাগের জন্য কংগ্রেস দায়ী। কংগ্রেসের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা দলটিকে ভারত ভাগে উৎসাহিত করেছে। ভারত ভাগের জন্য মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে দায়ী করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারাই বরং ভারতকে বিভাগের হাত থেকে রক্ষার জন্য কাজ করেছেন।' প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী 'পাঁচ নেতার শেষ জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা (২)' শিরোনামের উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন,' ইতিহাসের সত্য বেশিদিন গোপন থাকে না। এখন বহু ভারতীয় ইতিহাসবিদদের গবেষণাতেই বেরিয়ে আসছে যে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের জন্য জিন্নাকে যতটা দায়ী করা হয়, তার চাইতে অনেক বেশি দায়ী নেহেরু। ভারত ভাগের বদলে ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের এবিসি জোনে ভারতকে বিভক্ত করে একই শিথিল ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে রাখার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল জিন্না তা মেনে নিয়েছিলেন; কিন্তু নেহেরু তা সরাসরি প্রত্যাখান করেন। পরবর্তী সময়ে নেহেরু স্বীকার করেছেন, কেবিনেট মিশনের এবিসি পরিকল্পনা গ্রহণ না করা ছিল তার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল। নেহেরু-রাজনীতির আধুনিক বিশ্লেষকরা এখন আবিষ্কার করেছেন, এটা নেহেরুর ভুল ছিল না, ছিল জেদ এবং অন্ধ জিন্না বিদ্বেষের পরিণতি (উপসম্পাদকীয়, ১০.৭. ২০১২ ইত্তেফাক)।' ভারত বিভাগের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবৃতি এসেছিল ১৯৪৪ সালে কংগ্রেস নেতা রাজা গোপালচারীর মুখ থেকে। অখন্ড ভারত ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা দিয়ে নবগঠিত রাষ্ট্রগুলোর সীমানা চিহ্নিত করে একটি মানচিত্র ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ করেছিল ভারত ইউনিয়ন ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কথা উঠার বহু আগে।
সত্য বেশি দিন গোপন থাকে না। ভারত ভাগ ও দ্বিজাতি তত্ত্বের দায় যারা মুসলিম সম্প্রদায় ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের ওপর চাপাতে চায় তাদের ইতিহাসের সত্য গোপনকারী। ভারত ভাগ মুসলমানদেরই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কোটি কোটি মুসলমানকে উদ্বাস্তু, হাজার-হাজার মুসলমানের জীবনবধ, ভারত ইউনিয়নে অবস্থানকারী মুসলমানদের অনিরাপদ করেছে ভারত ভাগ-দ্বিজাতি তত্ত্ব। ভারত ভাগ- দ্বিজাতি তত্ত্ব ভারত উপমহাদেশের জাতীয় ঐক্য ধ্বংস করেছ, হিন্দু-মুসলিম সম্পদায়ের মধ্যে চিরদিনের জন্য অবিশ্বাস ঢুকিয়েছে, ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজবপন করেছে। দ্বিজাতি তত্ত্ব আবেগপ্রসূত ছিল না। দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রথম হিন্দু সম্প্রদায়ের মুখে শোনা গেলেও এ তত্ত্ব আদতে ইংরেজদের ব্রেইন চাইল্ড। ইংরেজদের ভারত উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস, বৈরিতা সৃষ্টির 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' পলিসির গর্ভে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভ্রূণ জন্মেছে। ভারত ভাগের কথাবার্তা এবং দ্বিজাতি তত্ত্ব আলোচনায় আসার বহু আগেই ইংরেজ শাসকরা ভারতে বাসকারী হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্ক ধ্বংসের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করেছিল অলিখিত 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' পলিসি। এ পলিসি ছিল ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন-শোষণ নির্বিঘ্ন ও দীর্ঘায়িত করার অব্যর্থ কৌশল।। ইংরেজ শাসকরা দুরভিসন্ধির এ পলিসি বাস্তবায়নে উগ্র হিন্দুদের অত্যন্ত সফলভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। এটা এখন প্রমাণিত যে, উগ্র হিন্দুদের সংগঠন 'হিন্দু মহাসভা'র নেতা বিনায়ক দামোদর সাভাকার ছিলেন ইংরেজদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি' বাস্তবায়নের নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বিনায়ক দামোদর সাভাকারের ১৩৭ জন্মবার্ষিকীতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু তার বস্নগে লিখেছেন,' হিন্দুত্ববাদের জনক বিনায়ক দামোদর সাভারকার ব্রিটিশ এজেন্ট ছিলেন। সাভারকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষ ছড়ানোর মাধ্যমে ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করতেন। সাভারকারই প্রথম দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার শুরু করেছিলেন (২.০৬.২০ ইনকিলাব)।'
ভারত উপমহাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের বসবাস। ধর্ম-বর্ণ-গোত্রগত বিভাজন সত্ত্বেও এসব মানুষ কখনোই পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করেনি। এসব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান ভারত উপমহাদেশকে দুনিয়ায় শান্তিরধাম পরিচিতি দিয়েছিল। ভারত উপমহাদেশে মুসলমান ও ইসলাম ধর্মের আগমনের পর মুসলমান বা ইসলাম ধর্মের প্রতি অন্য ধর্মাবলম্বীরা বিদ্বেষ মনোভাব দেখায়নি। অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলাম ধর্মকে সম্মান দেখিয়েছে, মুসলমানদের সঙ্গে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে মুসলমানদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। একইভাবে মুসলমানরাও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। ইংরেজদের আগমনের পরও বহুদিন ভারত উপমহাদেশ ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ভেদের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের জায়গা হিসেবেই দুনিয়ায় পরিচিত ছিল। ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ বণিকদের আগমনের অনেক পরে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর দুরভিসন্ধিতে ভারত উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন-বিদ্বেষের বীজবপন হয়েছে। সুচতুর ইংরেজরা তাদের রোপিত হিন্দু-মুসলিম বিভাজন-বিদ্বেষের বীজ থেকে গজানো চারা পরিচর্যা করে বট বৃক্ষে পরিণত করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিল উগ্রবাদী হিন্দুদের ওপর। উগ্র হিন্দুরা অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই উগ্র হিন্দুরা দ্বিজাতি তত্ত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছিল।
উগ্র হিন্দুদের উপস্থাপিত দ্বিজাতি তত্ত্ব অখন্ড ভারত উপমহাদেশ দ্বিখন্ডিত করেছে ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের দায় দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপকদের ওপরই বর্তায়। দ্বিজাতি তত্ত্বের উপস্থাপক-আবিষ্কারক মুসলিম সম্প্রদায় বা মুসলমানদের কোনো নেতা ছিলেন না। ইতিহাস মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারত উপমহাদেশ ভাগের দায়মুক্তি দিয়েছে।
জহির চৌধুরী : কলাম লেখক
পযড়ফিযঁৎুুধযরৎ@ুধযড়ড়.পড়স