রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২
পাঠক মত

সংস্কৃতি সংজ্ঞায়ন ও বাঙালি সংস্কৃতি

  ২৭ জুন ২০২১, ০০:০০
সংস্কৃতি সংজ্ঞায়ন ও বাঙালি সংস্কৃতি

সাধারণভাবে সংস্কৃতি হলো একটি সমষ্টিগত বৈশিষ্ট্য বা জ্ঞান। বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যতম অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো ভাষা, ধর্ম, অভ্যাস, কলা, সংগীত, সামাজিক আচার ইত্যাদি। যুগান্তর ও স্থানভেদে সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়। তাই প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। বাঙালিদেরও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। বঙ্গদেশে শত শত বছর আর্য, তুর্কি, আফগান- মোগল ও ইংরেজরা শাসন করেছে। সেই সব ধর্ম, বর্ণের মানুষের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে কিছুটা নিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালির নতুন এক সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিতে বিদেশিদের অনেক প্রভাব থাকলেও বাঙালির খাদ্যাভ্যাস বিশেষ করে ভাত খাওয়া অভ্যাসে ও পহেলা বৈশাখের চেতনায়ও কোনো পরিবর্তন হয়নি।

মোতাহার হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে বাঁচা, প্রকৃতি-সংসার ও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা, নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা, প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা, বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।'

সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা রয়েছে। তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য আলোচিত দুটি শাখা হলো যথাক্রমে- হাই-কালচার, লো-কালচার। মানুষের জীবনকে আধুনিক ও প্রাচীন উভয় কর্ম সম্প্রদায়নে বিভক্ত করে মানুষকে হাই-কালচার অথবা লো-কালচার শাখায় ভাগ করা যায়। হাই-কালচার বলতে সাধারণত ধরা যায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। যার বিষয়গুলো হবে আধুনিক। লো-কালচার হিসেবে বলা যায় দেশীয় প্রাচীন ঐতিহ্য। যার বিষয়বস্তু হবে নিজের বাবা-দাদাদের ঐতিহ্য ও অভ্যাস।

পাশ্চাত্য বা নিজ সমাজের অভিজাত্য মানুষের নান্দনিক ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য বা দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থাকে বলা যায় হাই-কালচার। উদাহরণ- দেওয়ালে ছবি টাঙানো, বিছানায় উঠে চা খাওয়া, উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠানে যাওয়া ইত্যাদি।

সাধারণত নিজ সমাজের গণমানুষের যে ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য বা দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থা তাকে বলা যায় লো-কালচার। উদাহরণ- সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন, পান্তা ভাত খাওয়া, নিজ প্রাচীন সংস্কৃতি যেমন লুঙ্গি পরিধান করা ইত্যাদি।

এছাড়া সংস্কৃতির বিভিন্ন স্থানে আমরা এগ্রিকালচার, হর্টিকালচার, পিসিকালচার ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে থাকি। এর উৎপত্তি চাষাবাদ বা ঈঁষঃরাধঃরড়হ হতে। কোনো নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে নিজেদের প্রয়োজনে বিশেষভাবে চাষ করা। সেই চাষাবাদ থেকে সংস্কৃতিতে শব্দগুলো এসেছে।

প্রত্যেক সমাজের ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। এই সংস্কৃতি কিছু ধরন বিদ্যামান। যথা- বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতি। বস্তুগত সংস্কৃতি হিসেবে বুঝি আসবাবপত্র, পোশাক, যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রভাবের কারণে অনেক সময় এসব জিনিসে এসেছে পরিবর্তন। যেমন- কৃষিকাজে মানুষের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগে মানুষ লাঙল দিয়ে বিভিন্ন কৃষিকাজ সম্পন্ন করত। কৃষিকাজে বর্তমানে লাঙল বিলুপ্তপ্রায়। এ ছাড়া মানুষ মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করত আর এখন স্টিলের তৈরি হাঁড়ি।

মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য যা ব্যবহার করা হয় তাকে বলে বস্তুগত সংস্কৃতি। উদাহরণ হিসেবে উলেস্নখ করা যায় ঘরবাড়ি, পাতিল ব্যবহার করে। মানুষের ঘরবাড়ি একসময় মাটি দিয়ে তৈরি হতো এখন ইট-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয় বহুতল ভবন।

যে সংস্কৃতির দৃশ্যমান কোনো বস্তুগুণ নেই কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির অংশ, তাকে অবস্তুগত সংস্কৃতি বলা যায়। উদাহরণ হিসেবে উলেস্নখ করা যায়- চিন্তা-ভাবনা, ধারণা, নিয়মনীতি, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, কথাবার্তা ইত্যাদি। সংক্ষেপে ভাবগত সংস্কৃতিগুলোকে অবস্তুগত সংস্কৃতি বলতে পারি। এছাড়া মানুষের জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, আইন-আদর্শে শিল্পকলা, বিশ্বাস-অভ্যাস অবস্তুগত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসন ইয়োং বেঙ্গলদের মাধ্যমে এসব তুলে ধরেছেন।

বস্তুগত সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য এই সংস্কৃতি মানুষের জীবনে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণ- ঘড়-বাড়ি, আসবাবপত্র পোশাক ইত্যাদি। এই সংস্কৃতি দ্রম্নত পরিবর্তনশীল।

অবস্তুগত সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য এই সংস্কৃতি মানুষের জীবনে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণ- শিল্পকলা, সাহিত্য, সংগীত, প্রযুক্তি ইত্যাদি। এই সংস্কৃতি বস্তুগত সংস্কৃতির চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় নিয়ে পরিবর্তনশীল।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বলতে সাধারণত পশ্চিমের মহাদেশগুলো কিছু দেশের সংস্কৃতি বোঝায়। সাধারণত ইউরোপ এবং আমেরিকা ও ইংরেজদের মূল্যবোধ, রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সারা বিশ্বব্যাপী বিশদভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। সাধারণত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা বা ইংরেজরা একসময় সারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিল। প্রায় ২০০ বছর ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছিল তারা। এভাবেই আস্তে আস্তে সামাজিকভাবে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি তারা সংস্কৃতিতে অনেক প্রভাব ফেলেছে।

বিভিন্ন জাতি তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক শৃঙ্খলা, ভাষার প্রতি অনুরাগী হয়ে নিজেও তা গ্রহণ করেছেন। পশ্চিমা সংস্কৃতির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন- দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও রাজনীতিতে যৌক্তিক চিন্তাধারা। ইংরেজরীতিতে নাগরিক ও সামরিক ঐতিহ্য, খ্রিষ্টান ধর্ম, পুঁজিবাদ অর্থনীতি, গণতন্ত্র ধারণা।

বাঙালি সংস্কৃতি বলতে সাধারণত এশিয়া মহাদেশের ভারতের কিছু অংশ এবং বাংলাদেশের মানুষের জীবনব্যবস্থা ও সংস্কৃতি বোঝায়। সাধারণত এই দেশ ও রাজ্যগুলোর মানুষের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতি ব্যবস্থাকে বোঝানো যায়।

বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। সাধারণত প্রবাসীদের মাধ্যমে এসব দেশগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে সংস্কৃতিচর্চার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কম থাকায় বাঙালিরা নিজেদের সংস্কৃতির মর্ম বুঝতে অক্ষম। এই সংস্কৃতি এখন এক মিশ্র সংস্কৃতির বললেও ভুল হবে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে শাসনে এসেছে তাদের সংস্কৃতি এখন এখানে ছড়িয়ে রেখেছে। বাঙালিরা নিজেদের সংস্কৃতির থেকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে বেশি ঝুলে পড়ে। অনেক বাঙালি আবার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কিছু প্রাচীন জীবনব্যবস্থাকে নতুনরূপে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। বাঙালিদের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন- বাংলা নববর্ষ, নবান্ন উৎসব, শীতের পিঠা-পুলির উৎসব, গ্রামীণ খেলাধুলা, গোলস্নাছুট, হাডুডু খেলা, নৌকা বাইচ, লুঙ্গি পরা ইত্যাদি।

এছাড়া বাংলার নগরগুলোতে বিদেশি পাশ্চাত্যের মিশ্র প্রভাব থাকলেও নতুন কাব্য লেখা, সৃজনশীল চিন্তা, সংগীত ভাষা ও সাহিত্যকলা ব্যাপকভাবে উলেস্নখ্য। এছাড়া হিন্দুদের দুর্গাপূজা, মুসলিমদের ঈদের বিভিন্ন আয়োজন বাঙালির আপন সংস্কৃতি।

বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বাংলা সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটেছে। গ্রামের তুলনায় নগরগুলোতে এই ধারণা সুস্পষ্ট চোখে পড়ার মতো। নিজ সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে সবাই ঝুঁকে পড়েছে পাশ্চাত্যের বিকশিত সংস্কৃতিতে। বাঙালি সংস্কৃতিতে এমন অপবিকাশ সাধনে সংস্কৃতি রূপান্তরিত হতে পারে অপসংস্কৃতিতে। বলা যায়, বর্তমান বিশ্বে খুব দ্রম্নতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অবক্ষয় হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নারীবাদী ও বিভিন্ন যুক্তিবাদীদের কথা। সাধারণত বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করছে বাঙালি।

বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এখন আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা কোনোভাবেই বিষয়টি ছোট্ট ঘটনা হিসেবে ধারণা করতে পারি না। সংগীতের নামে কোলাহল, শিল্পের নামে অপ্রাসঙ্গিক কাহিনী। চিত্ত বিনোদনের নামে বাঙালিদের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে যৌনতা প্রদর্শন। এভাবে আপন সংস্কৃতি চলে যাচ্ছে পাশ্চাত্যদের দিকে। এটাকে পুনঃস্থাপন করা খুবই প্রয়োজন।

বর্তমান বিশ্বায়নের এই যুগে থেকে আমাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা যা যা করতে পারি: পাশ্চাত্য মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ও তাদের অন্ধ অনুকরণ বন্ধ করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতিকে আরও মননশীল এবং নিজেদের প্রচেষ্টায় আধুনিক করে তুলতে হবে। বিদেশি সংস্কৃতির উত্তম দিক গ্রহণ ও খারাপ দিক বর্জন করতে হবে। ছোট্টদের আপন সাহিত্য ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংযত রাখলে আমাদের অবক্ষয়ময় সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব।

সংস্কৃতি সমাজের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যভাবে বলা যায় সংস্কৃতি হলো সমাজের একটি প্রতিচ্ছবি। সংস্কৃতির মরণ হলে মৃতু্য হয়ে যেতে পারে একটি জাতির। সকল প্রকার অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার ফলে বাঙালি সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া যায় পৃথিবীর সব প্রান্তে। পৃথিবীর বুকে শুধু সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা নয়- বাঙালিদের কীভাবে সংস্কৃতি বেগমান করা যায় সেই চিন্তা-চেতনা ধারণ করতে হবে। এই অবক্ষয় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারলে সমগ্র বিশ্বের কাছে সম্মানিত হতে পারে বাঙালি সংস্কৃতি।

রানা আহম্মেদ অভি

শিক্ষার্থী, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে