শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুতুলের মহৎ কাজের গুরুত্ব অনস্বীকার্য ড. মিল্টন বিশ্বাস

নতুনধারা
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

৯ ডিসেম্বর সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্মদিন। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ সালের এই দিনে তার জন্ম। বলা যায় জন্মের সময় এই শিশুর মুখ, তার হাসি-কান্না জাতির পিতার সান্নিধ্যে মধুমাখা হয়ে উঠেছিল। তিনি বাংলাদেশের অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। সায়মা ওয়াজেদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি এবং বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে। 'আমি মা' শীর্ষক রচনায় শেখ হাসিনা লিখেছেন- 'একদিকে জনগণ এবং অন্যদিকে আমার সন্তান কাউকেই আমি ভিন্ন চোখে দেখতে পারি না।' ১৯৭৫ সালে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদা জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তিনি ও তার সন্তান এবং বোন রেহানা ও তার সন্তানদের নিয়েই তার পরিবার। এর বাইরে তার পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই। প্রধানমন্ত্রীর পিতা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিশারি, স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী, ছেলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, মেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। একটি পরিপূর্ণ আলোকিত পরিবারের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী বাল্যকাল থেকেই পিতার রাজনৈতিক আদর্শে বেড়ে উঠেছেন। এজন্য শেখ হাসিনা পরিবারের ঔদার্য বিশাল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ঘটনা দিয়ে সেই উদার-হৃদয়ের মানুষদের আমরা চিনতে পারি। সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের কৃতিত্ব তার পরিচয়কে মহিমান্বিত করেছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ব্যারি ইউনিভার্সিটি 'ডিসটিংগুইসড অ্যালামনাই অ্যাওয়ার্ডস' প্রদান করেছে পুতুলকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যসেবায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননার সাইটেশনে উলেস্নখ করা হয়েছিল- সায়মা একজন মনোবিজ্ঞানী এবং শিশুদের অটিজম বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন প্রবক্তা। তিনি ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত হয়।' ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়বিক জটিলতা-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন সায়মা। প্রথমে নিজের দেশ বাংলাদেশে কাজ করেন এবং পরবর্তীকালে জাতিসংঘ এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করেছেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে 'হু এক্সিলেন্স' অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। তিনি ২০১১ সালে ঢাকায় অটিজমবিষয়ক প্রথম দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। ২০১৬ সালে সায়মা ওয়াজেদ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের জন্য ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশ পুতুলের কারণে আজ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিচিত। ২০২০ সালের জুলাই মাসে সায়মা ওয়াজেদ সিভিএফের থিম্যাটিক রাষ্ট্রদূত হন। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য গঠিত ফোরামের কাজে তার সম্পৃক্ততা করোনা মহামারিতে প্রশংসিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেও সারাবিশ্বে তিনি অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশে অটিজমবিষয়ক বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণে উলেস্নখযোগ্য সাফল্য লাভের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে অটিজমবিষয়ক 'শুভেচ্ছা দূত' হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ কাজ করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে- অটিজম এক ধরনের জটিল স্নায়ুবৈকল্য বা কমপেস্নক্স নিউরোলজিক্যাল ডিস্‌অর্ডার (পড়সঢ়ষবী হবঁৎড়ষড়মরপধষ ফরংড়ৎফবৎ)। অটিজমে ব্যক্তির মধ্যে কমিউনিকেশন ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় বৈকল্যসহ আচরণ, আগ্রহ বা শখ এবং কর্মকান্ডে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়। সাধারণত অটিজমযুক্ত ব্যক্তির কথাবার্তা বা কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে বৈকল্য ও অসঙ্গতি দেখা যায়। যথা- দেরিতে কথা বলা, জবান বা বোল বা বাক্‌ প্রভৃতিতে প্রতিবন্ধকতা। সেই সঙ্গে সামাজিক দক্ষতায়ও পরিলক্ষিত হয় বৈকল্য ও অসঙ্গতি। আচরণিক ক্ষেত্রেও এদের মধ্যে কিছু অঙ্গের, যেমন- হাত, আঙ্গুল, মাথা প্রভৃতি ঘোরানো বা নড়া-চড়ার আচরণও দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে অটিজমে শিশু কিংবা বয়স্ক ব্যক্তি সমাজের বোঝা না হয়ে আশার বাণী নিয়ে আবির্ভূত হতে পারেন- এই বাস্তবতায় মানুষকে সচেতন করে তুলেছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পক্ষেই মানুষের জন্য কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। কারণ বঙ্গবন্ধুও বাল্যকাল থেকে পরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করতে শিখেছিলেন আর নিজে ধনপতি না হয়ে সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ছিলেন। আসলে বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা বহমান তা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তারই যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল- এই তৃতীয় প্রজন্মের নতুন নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সব আকর্ষণ এখন কেন্দ্রীভূত। পুতুলের ভেতর রয়েছে শেখ হাসিনার মতো প্রচন্ডতা। রয়েছে পরিশ্রমী ও তারুণ্যের প্রাণময়তা। এজন্য রাজনীতিতে যোগ না দিয়েও তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি মুখ। দেশের মধ্যে যারা এক সময় দুর্নীতি ও নাশকতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন তিনি। তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষকে আশাবাদী করে জাগিয়ে তোলার জন্য কাজ করেন, কথা বলেন কম। এক সময় তার মতো বয়সে বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষকে ভালোবেসে কাজ করেছিলেন। তার ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধুর মতোই সম্মোহনী চেতনা স্ফুরিত হচ্ছে। তিনি অসহায়দের পক্ষে কাজ করে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন মানবতার সেবায়।

যে মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তার পুরোভাগেই তিনি আছেন। শেখ হাসিনা যেমন নির্লোভ, মানুষকে ভালোবাসেন নিজের অন্তর থেকে পুতুলকেও তেমনিভাবে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিরুদ্ধ মানুষের মন জয় করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে কাছে টানতে শেখ হাসিনা সরকারের কর্মসূচি, সাফল্য বর্ণনা করতে নিজের ব্যতিক্রমী কাজের মধ্যে মা, মাটি, মানুষের নিকটজন হয়ে উঠেছেন তিনি। নতুন ও আধুনিক একটি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যেমন ধরে রাখতে হবে তেমনি মানবিক বাংলা গড়ার জন্য পুতুলের মহৎ কাজের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন-এ প্রচারিত অনুষ্ঠানে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি নানা প্রসঙ্গে গঠনমূলক কথা বলেছেন। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে 'লেটস টক' শিরোনামে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন, ক্ষমতাসীন সরকার অটিজমের ইসু্যতে কাজ করছে। দেশের মানুষের প্রতি এ সরকার আন্তরিক। মানুষের দুঃখকে অনুভব করতে সক্ষম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পিতা-মাতা ড. ওয়াজেদ ও শেখ হাসিনার মতো আন্তরিক হৃদ্যতায় সাধারণ মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। এর আগে তিনি দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নিভৃতে থেকে। বঙ্গবন্ধুর নাতনি এবং শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার কন্যা হিসেবে পারিবারিক সূত্র গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তিনি যে মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করতে এসেছেন তা বোঝার ক্ষমতা নেই বিএনপি-জামায়াত নেতাদের। তারা পুতুলের নীরবে কাজ করে যাওয়ার মতো নেতা তৈরি করতে পারেনি। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের পক্ষে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করাটাই স্বাভাবিক। এটা ঠিক যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ এখনো রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দল। এখানে অন্য কোনো দলের এত শক্তি নেই যে তারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সমান হতে পারে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যে গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে তা অন্য কোনো দলের নেই। পুতুল সেই গৌরবকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে না গিয়ে নিজের যোগ্যতায় কাজ করে চলেছেন।

মধ্যবিত্তের সন্তান বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁসির ভয়কে উপেক্ষা করেছেন। জেল খেটেছেন মাসের পর মাস। সেই ত্যাগী নেতার নাতনি হিসেবে পুতুলকে মনে রাখতে হচ্ছে, এ দেশের মূঢ়, মূক মানুষের মুখে দিতে হবে ভাষা। তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় নিয়েই। জাতির পিতা নিজের সন্তানকে রাজনীতিতে এনেছিলেন। আর তা ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পারিবারিক পর্যায়ে তিনি যা করেছিলেন তা ছিল দেশের স্বার্থে, মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে। অনেকেই তার বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচারণ করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য মমত্ববোধকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।

অসহায়দের পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা পুতুল এগিয়ে এসেছেন মানুষের আকর্ষণে। মাতার সান্নিধ্য তাকে রাজনীতির সঙ্গে মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। তার কার্যক্রম প্রসারিত হওয়ায় আওয়ামী সমর্থক সবাইই খুশি। কারণ তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। আওয়ামী লীগকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নেতৃত্ব ও উন্নয়নকে একই সঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। পুতুল হঠাৎ আবির্ভূত হননি। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার রয়েছে দৃঢ়চেতা অভিভাবক। যিনি সব বিষয়ে সুপরামর্শ দিতে পারঙ্গম। কখনও পথ চলতে ছিটকে পড়লে শেখ হাসিনা পরামর্শ দিয়ে ঠিক পথে আনতে পারবেন তাকে। কারণ পুতুল একান্তই মাতৃ অনুগত। তিনি আওয়ামী লীগের জন্য নীরবে কাজ করে চলেছেন। এগিয়ে যাচ্ছেন বিচক্ষণতার সঙ্গে। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্মদিন সার্থক দেশমাতৃকার তরে। বাংলাদেশ তার কারণেই আজ গৌরবান্বিত।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে