শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আফগানিস্তানে তালেবান শাসন

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলেছে। অর্ধশতাব্দীব্যাপী চলমান গৃহযুদ্ধে দেশ ও জনগণের অনেক ক্ষতি হয়েছে। যার প্রভাব এখন তীব্র।
মোহাম্মদ শামুসল কবির
  ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

দুই দশকের সহিংস লড়াইয়ের পর আবার তালেবানদের দখলে এলো আফগানিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে ২০০১ সালে ক্ষমতা হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়া তালেবান বিনা রক্তপাতে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসন চালানোর আগে এর বেশির ভাগ জায়গায় তালেবানের শাসন ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় তালেবান সরকারের পতন হয়। ২০ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা তালেবান ধীরে ধীরে সামরিক শক্তি সঞ্চয় করে। বিশেষ করে প্রাদেশিক শহরগুলোর বাইরে তারা সংঘটিত হতে থাকে পুরোমাত্রায়। কারণ মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যদের নজরদারি ছিল কেবল শহরকেন্দ্রিক। যার কারণে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে অধিকাংশ শহর তারা দখলে নেয়। আফগানিস্তানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, একটা সময় প্রায় হাজার বছরের বেশি বৌদ্ধ ধর্ম এবং সে সময়ের হিন্দু শাসনকালের পর সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর ভিতর আরব আক্রমণের ফলে সমগ্র আফগানিস্তানে ধর্ম হিসেবে ইসলামী জনগোষ্ঠীর বসবাস, পাশাপাশি বিভিন্ন উপজাতিরাও বাস করতে থাকেন। তবে এটা পরিষ্কার যে আফগানিস্তানে বহিরাগত শাসন সেখানে স্থায়ী হয়নি। কোনো ধরনের দখলদারি, আধিপত্য তারা মনে-প্রাণে নিতে পারেনি! তাদের ছিল প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। তেল, গ্যাস, সোনা আর আফিম। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ব্রিটিশরা ১৮৩৯-১৮৪২ সালে এখানে পর্যুদস্ত হয়েছে, তার আগে মুঘল শক্তি। আফগানিস্তানে জয় করার প্রধান বাধা তিনটি। এক, আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান ইরান মধ্যএশিয়া ও ভারতের মধ্যবর্তী অঞ্চল। আফগানিস্তান বহুবার আক্রান্ত হয়েছে এবং এই দেশের বসবসকারী উপজাতিরা বিদেশি শক্তির পক্ষে বিরাট প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়, বার বার আক্রমণের মুখে পড়ে এই এলাকার লোকজন আইনের শাসন কী তা জানে না। এটি যেন একটি দুর্গের রূপ নিয়েছে। তৃতীয়, আফগানিস্তানের যে চেহেরা দেখতে পাই সেখানে একটি স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। বিদেশি শক্তির বিজয় ও শাসনকে দুরূহ করে তোলে প্রতিনিয়ত। আফগানিস্তানের চারপাশ খুব উঁচু। যাদের মধ্যে রয়েছে হিন্দুকুশ। এ ছাড়া রয়েছে কারাকোরাম তিয়েনমান, কুনসুন এবং হিমালয়। এই প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ ও আফগানিস্তানের মানুষের চরিত্র বদলে দিয়েছে। ইতিহাসে বার বার দেখা গেছে, শেষ বেলায় আফগানিস্তান জয়ী হয়। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর তালেবানদের সৃষ্টি হয়। এটি একদিনে বা বছরে হয়নি? ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর পুরো দশ বছর তারা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থেকে ১৯৮৯ সালে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে উত্তর পাকিস্তানে তালেবান আন্দোলনের জন্ম হয়। এই আন্দোলন মূলত পশতুন অর্থাৎ পশতুভাষীদের প্রাধান্য। ধারণা করা হয়, এরা মাদ্রাসাগুলোয় সংগঠিত হতে থাকে।

১৯৯৬ সালে কাটুল ও কান্দাহার দখল করে তালেবানরা। এরপর প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রব্বানির সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে। সেটির সময় হলো ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। আফগানিস্তানকে নিজেদের কবজায় আনার পর সে দেশে কঠোর ইসলামি শাসন জারি করে তালেবানরা। মেয়েদের বোরকা পরা, মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে তারা। টেলিভিশনে সংগীত সিনেমা নিষিদ্ধ করে তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আন্তর্জাতিকভাবে তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিস্নউ বুশ বিশ্ব থেকে সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদের অঙ্গীকার করেন। ওই সময় আফগানিস্তানের শাসক গোষ্ঠী তালেবানকে আলকায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনসহ সংগঠটির লুকিয়ে রাখা তাদের যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান বুশ। তালেবান এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে। তারপর ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালে কংগ্রেস মার্কিন বাহিনীকে দেশটিতে পাঠানোর পরিকল্পনার অনুমোদন দেয়। এরপর ২০০১ সালের ৭ মাফিয়া যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা অপারেশন নন ডিউরিং ফ্রিডম এ যুদ্ধে যোগ দেয়। মিত্র যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটো দেশগুলো।

তারপর লাদেনকে হাতে পেতে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায় আমেরিকা। এরপর ২০ বছর আফগানিস্তানে শেকড় গাড়ে আমেরিকা। কিন্তু তালেবান মুক্ত করতে পারল না আফগানিস্তান। যুদ্ধে মূল টার্গেট তালেবান এবং আলকায়দা হলেও দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণ হারায় সাধারণ আফগান। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে তাদের মনোনীত হামিদ কারজাইকে ক্ষমতা প্রদান করে। যুদ্ধে জর্জ ডবিস্নউ বুশ, বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এরপর জো বাইডেন এসেছে কিন্তু সবাই একই পন্থা অবলম্বন করেছে। যুদ্ধ, স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা, খনিজসম্পদ আহরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এমনকি ভারতও কম চেষ্টা করেনি আফগানিস্তানকে নিয়ে। কিন্তু তার ফল কি হয়েছে বিশ্ববাসী তা ভালো করে জানে। যুদ্ধে বিপুল অর্থ খরচ করেও আফগানিস্তানকে পরাস্ত করতে পারেনি। পারেনি তালেবানদের। তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। এর মধ্যে যুদ্ধে খরচ হয় ৮০ হাজার কোটি ডলার ৮ হাজার ৫০০ কোটি আফগান সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণে। এই বাহিনীর বেতন গুণতে হয়েছে ৭৫ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ কোটি ডলার খরচ করতে হয়েছে। ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৪০০ সেনা নিহত হয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রায় ৪ হাজার নিহত হয়েছে তালেবানদের হামলায়। যুদ্ধে আহত হয়েছে ২০ হাজার সেনা, চিকিৎসক। যুক্তরাষ্ট্রকে আরও গুণতে হবে ৩০ হাজার কোটি ডলার। এক কথা প্রচুর অর্থ ব্যয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু ফল শূন্য, একসময় ভিয়েতনাম থেকে এই যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন অর্থ খরচ হয়েছে তেমনিভাবে তালেবানদেরও ক্ষতি কম হয়নি? বহু ইতিহাস, ঐতিহ্য ধ্বংস হয়েছে। জো বাইডেন যখন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বললেন তখন সেখান থেকে প্রত্যাহার শুরু হয়।আফগানিস্তান ছাড়ার আগে ৯৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক যান ধ্বংস করে গেল মার্কিন বাহিনী। সর্বশেষ ৩০ আগস্ট ২০২১ যুদ্ধ শেষ হয়ে তারা অর্থাৎ মার্কিন সৈন্যবাহিনী আফগান ত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

তারপর দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে আফগান শরণার্থীর ঢল। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ২০১৮ সালে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে প্রতিদিন ৩৫ হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ যা এ যাবৎকাল রেকর্ড। ১৯৭৯ সাল সোভিয়েত রাশিয়া ও আফগানিস্তানের বড় ধরনের সেই লড়াইয়ে ২৮ লাখ আফগান পাকিস্তান এবং ১৫ লাখ আফগান ইরানে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ১০ বছর পর রাশিয়া আফগানিস্তান থেকে চলে যায়। তারপর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আলকায়দার নামে তালেবানদের প্রতি কম অত্যাচারিত হয়নি। এখনো প্রায় ২০ লাখের বেশি আফগান নাগরিক পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। এভাবে ২০০১ কাবুলের পতনের পর ২০০৪ সালে হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট হন। যুক্তরাষ্ট্র নতুন নতুন ফন্দি চালাতে থাকে। ২-০৫-২০১১ ওসামান বিন লাদেন পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র কমান্ড পরিচালনার সঙ্গে তাকে মারা হয়। তারপর ২০১৩-তে তালেবানদের কমান্ড মোলস্না ওমর মৃতু্যবরণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১-এ আগস্টের শেষে তালেবান আফগান পুনরায় দখল করে ক্ষমতায় আসে।

পরিশেষে বলতে চাই, দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধে আফগানদের যে ক্ষতিসাধন হয়েছে, তা পূরণ করতে বেশ দীর্ঘসময় লাগবে। কারণ স্থিতাদের তাদের ধ্বংস হয়ে যে অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যুদস্ত হয়েছে, সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘ ও স্বার্থসিদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে হবে। যেমন ইতোমধ্যে চীন, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, তুরস্ক, ইরান ইত্যাদি দেশ হাত বাড়ানোর কম বলেছেন। নারীদের বেলায় কঠোর না হয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচয় দিতে হবে। দেশকে গড়ার কাজ আগে হাতে নিতে কবে। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ বিভিন্ন ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মাণের জন্য দ্রম্নত কাজ আসতে হবে তালেবানদের হাতে। পররাষ্ট্রনীতি তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বের সঙ্গে। কেননা তাদের বুঝতে হবে ৭২ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। ৬৫ শতাংশ মানুষ এখনো বিদু্যৎ সুবিধা পায় না।

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলেছে। অর্ধশতাব্দীব্যাপী চলমান গৃহযুদ্ধে দেশ ও জনগণের অনেক ক্ষতি হয়েছে। যার প্রভাব এখন তীব্র।

আন্তর্জাতিক মহলে তালেবানদের যে বুঝতে হবে ২০০১-এর তালেবান আর ২০ বছর পর তালেবান এক নয়। তাদের হতে হবে উদার ও সহনশীল। দেখা যাক সময়ই বলে দেবে তালেবানদের হাতে দেশ আগামীতে কোথায় পৌঁছাবে। তবে, দেশে শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি ঘটুক এই কামনায়।

মোহাম্মদ শামুসল কবির : লেখক ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে