একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বৈদেশিক শক্তির অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাশিয়ার ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা বাহিনী যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করছে তখন বিশ্বের কিছু শক্তিধর দেশ বাংলা স্বাধিকারের প্রশ্নে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এমন সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তুমুলভাবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে আমেরিকা নিরপেক্ষ অবস্থায় থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা পাকিস্তান সরকারের পক্ষ নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এই মৈত্রী চুক্তির সুবিধা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই চুক্তির কারণেই চীন ও আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করতে গিয়ে বিশ্বমঞ্চে একঘরে হতে যাচ্ছিল। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার দৃঢ় সহযোগিতায় ভারতের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে। কিন্তু সেই আলোচনায় আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন একমত হতে পারেনি। নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। আমেরিকা ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে রাজি হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে বারবার নাকচ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি প্রস্তাবে রাজি হয় তাহলে তা পাকিস্তানকে সহায়তা করবে এবং বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হতে পারবে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি রাশিয়া এভাবে সমর্থন না করতো তাহলে ভারত বাংলাদেশকে সমর্থন করতে পারত না। এই বৈদেশিক শক্তির সমর্থন না পেলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করত কিনা এই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সামরিক ও আর্থিক সহায়তা এবং সামগ্রিকভাবে নৈতিক সমর্থন প্রদান করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে প্রায় পরাজিত পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে তার সপ্তম নৌবহরকে প্রেরণ করে। এর প্রতু্যত্তরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর প্রতি সম্ভাব্য মার্কিন হুমকি প্রতিহত করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর এবং ১৩ ডিসেম্বর ভাদিভস্তক থেকে সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের দুই স্কোয়াড্রন ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ার এবং পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি পারমাণবিক ডুবোজাহাজ প্রেরণ করে। ফলে আমেরিকার নৌবহর সহযোগিতা করতে পারেনি। এদিকে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করলে আমেরিকার নৌবহর ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ মার্চ বাংলাদেশের দুর্দিনে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। আমাদেরও মনে রাখতে হবে বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়ার অবদান কতখানি।
মো. সুজন মিয়া
শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়