শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের টাকা বিদেশে পাচার

নতুনধারা
  ২৯ মে ২০২২, ০০:০০

টাকা শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কারণ জীবনধারণের জন্য টাকার কোনো বিকল্প নেই। মানবজীবনে বেঁচে থাকতে হলে টাকার প্রয়োজন হবেই। বর্তমান সময়ে দেশে প্রায় সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বগতি কিন্তু মানুষের আয় উপার্জনের কোনো ঊর্ধ্বগতি নেই। এমন অবস্থায় অনেকে টাকার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কিন্তু প্রতি বছর লাখ লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই অর্থ পাচার থামছেই না। আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে পালস্না দিয়ে অঙ্কটি বড়ই হচ্ছে। এই পাচারকৃত টাকার সঠিক হিসাব না জানা গেলেও বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে।

গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গেস্নাবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগও মুখ থুবড়ে পড়েছে। একটি ঘটনায় মাত্র ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। কারণ হিসেবে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অবশ্য জিএফআইয়ের তথ্য আস্থায় নিতে রাজি নন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থ পাচারের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। বর্তমানে এমন অনেক খাতে অর্থ পাচার হচ্ছে, যা জিএফআই আমলে নেয় না। ওদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমদানির কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রতি বছর রেকর্ড গড়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওভার ইনভয়েস এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের হারও অনেকখানি বেড়েছে।

জিএফআইয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪২৬ কোটি মার্কিন ডলার। একই ধারায় ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি, ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি, ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি এবং ২০১৫ সালে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়। এরপর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানিয়ে সংস্থাটি বলেছিল, বিগত বছরগুলোতে অর্থ পাচারের ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে। আগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছিল, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সে হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে পাচার হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন বলছে, প্রধানত ১০টি দেশ এই অর্থ পাচারের বড় গন্তব্যস্থল। দেশগুলো হলো- সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। আর পাচার চলছে মূলত বাণিজ্য কারসাজি ও হুন্ডির মাধ্যমে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৬ বছরে যে পরিমাণ অর্থ পাচারের কথা বলা হচ্ছে, তা সর্বশেষ দুই অর্থ বছরের মোট বাজেটের কাছাকাছি। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার না হলে দেশে বর্তমানে জিডিপির আকার ছাড়িয়ে যেত সাড়ে ৪০০ বিলিয়ন ডলার। অনেকে তুলনা করে বলছেন, পাচারের এই টাকা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু বানানো যেত। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম অংশ মেট্রো রেলই বা কতগুলো বানানো সম্ভব ছিল, এ হিসাবও কষছেন কেউ কেউ। উলেস্নখ্য, পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং মেট্রো রেল প্রকল্পের ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা। পাচারের এই অর্থ দিয়ে দেশের বড় বড় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত খুব সহজেই। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারে যে তথ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ করছে, সেটাও আংশিক। বাস্তবে পরিমাণ আরও অনেক বেশি। অনেক বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন। তারা আয়ের বড় একটা অংশ অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান। এটাও অর্থ পাচার। এই তথ্য কিন্তু বৈশ্বিক সংস্থাগুলো উলেস্নখ করে না। তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের তথ্য দেয়। এদিকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে মাঝেমধ্যে জোরালো বক্তব্য শোনা গেলেও তা বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না। আইনি জটিলতা, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, আদালতে আসামিপক্ষের সময়ক্ষেপণ, সমন্বয়ের অভাব এবং উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ থাকাসহ নানা জটিলতার কারণে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা যাচ্ছে না। অর্থ পাচারের ৯৫ শতাংশ মামলাই নিষ্পত্তি হয়নি। মোট মামলার তিন-চতুর্থাংশই পারেনি নিম্ন আদালতের গন্ডি পেরোতে। সুপ্রিম কোর্ট ও দুদকের তথ্য বলছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলার সংখ্যা ৪০৮, যার মধ্যে ১৮৭টি মামলা দুদকের। ৮৫টি মামলার বিচার চলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। আর ঢাকায় ১০টি বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন ১৮৫টি মামলা। এর মধ্যে হাইকোর্টের আদেশে ৫২টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত আছে। আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে ২০টিরও কম মামলা। উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও ২০-এর বেশি নয়।

টাকার অভাবে খাদ্য কিনতে পারছে না হতদরিদ্র মানুষ। জীবিকার তাগিদে অনেকে গ্রাম থেকে শহরে আসছেন, কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না, না খেয়ে দিন পার করছেন প্রতিনিয়ত। তাই সরকারের উচিত অর্থ পাচার রোধ করতে আরও বেশি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। অর্থ পাচার, স্থানান্তর ও রূপান্তরকে 'শাস্তিযোগ্য অপরাধ' গণ্য করে ২০১২ সালে প্রথমে 'মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন' প্রণীত হয়। পরে এই আইন সংস্থার করা হয়। সরকার এই আইনের প্রতি আরও জোরদার করলে দেশে অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব। দেশকে আরও উন্নত করতে এর কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সব টাকা উদ্ধার করে দেশের উন্নয়নে ব্যবহার করতে হবে।

সাকিবুল ইসলাম

শিক্ষার্থী

সমাজকর্ম বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে