বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পদযাত্রা আন্দোলনের উত্তাপ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে

দলীয়ভাবে পদযাত্রা আহ্বান করার পূর্বে দলটির উচিত মানুষের দ্বারে দ্বারে যেয়ে মানুষের প্রত্যাশা, প্রাপ্তির সম্মেলনে গ্যাপসমূহ বের করে মানুষের কল্যাণে রাজনীতি নির্ভর কর্মসূচি প্রণয়ন করা। কিন্তু জনগণ থেকে বিচু্যত হয়ে রাজনীতির মাঠে কোনো কর্মসূচি সফল করার নজির এ দেশে নেই।
মো. সাখাওয়াত হোসেন
  ২৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

পদযাত্রা আন্দোলন, লং মার্চ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ প্রভূত বিষয়গুলো দাবি দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দাবির প্রকৃতি, দাবির বাস্তবতা, দাবির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে পদযাত্রার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা। তবে একটা সময় পদযাত্রার স্বর্ণযুগ ছিল এবং পদযাত্রার প্রকৃতিও ছিল জনগণকেন্দ্রিক এবং দাবির যৌক্তিকতা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য আকারে উপস্থাপিত হতো। কিছু কিছু জায়গায় এমন হতো সরকার পক্ষও প্রত্যাশা রাখতো, পদযাত্রার ন্যায় আন্দোলন হলে সত্যিকারের দাবিটিকে কার্যকর করা সম্ভব হবে। রাজনীতির মাঠে রাজনৈতিক মোর্চায় পদযাত্রার প্রয়োজন রয়েছে তথাপি পদযাত্রা হতে হবে জনগণের মর্জিমাফিক। না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পদযাত্রার স্বব্যাখ্যাত আবেদন জৌলুস হারাচ্ছে, পদযাত্রার আবেদনকে ভুলতে বসেছে তরুণ প্রজন্ম। ক্ষণে ক্ষণে দেখা যাচ্ছে, পদযাত্রা হচ্ছে তবে পদযাত্রায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নেই। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো পদযাত্রার বিষয়বস্তু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনয়ন করতে পারে না। পদযাত্রা যদি হয়ে থাকে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে তাহলে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ আশানুরূপ হবে না। সে কারণেই আয়োজকদের পদযাত্রার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে জেনে বুঝে পদযাত্রার কর্মসূচি আহ্বান করা উচিত। আর আয়োজনকারীদের উদ্দেশ্য যদি নেহাতই ব্যক্তিগত চরিতার্থমূলক হয়ে থাকে তাহলে পদযাত্রা কখনোই আলোর মুখ দেখবে না, পদযাত্রা জনগণের সন্মুখে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, পদযাত্রার আবেদন ক্রমান্বয়ে তলানির দিকে নেমে যাবে। কিন্তু পদযাত্রার রয়েছে গৌরবজ্জল ইতিহাস, বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনে জনমত তৈরির লক্ষ্যে পূর্বতন নেতারা পদযাত্রার মাধ্যমে আন্দোলনের যাত্রা শুরু করেছিল এবং জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আন্দোলনগুলো সফলতার মুখ দেখে। অর্থাৎ পদযাত্রার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিবেকের তাড়না সৃষ্টি হয়, আন্দোলন সম্পর্কে অবগত হয়, আন্দোলনের মাহাত্ম্যবোধের জাগরণ ঘটে।

কাজেই, বাংলাদেশে সমকালীন রাজনীতিতে পদযাত্রা আয়োজন সংক্রান্তে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর সাধারণ জনতার নজরদারি থাকে। বিশেষ করে পদযাত্রা আন্দোলনের আহ্বানকারী কারা? এদের রাজনৈতিক পস্ন্যাটফরম, ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত অর্জন, দায়িত্বশীল পদে দায়িত্বরত ছিল কিনা, দায়িত্বরত অবস্থায় অনিয়মের ফিরিস্তি রয়েছে কিনা, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে কিনা এসব বিষয় যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে সাধারণ জনতা আহ্বানকারীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। সে হিসাবনিকাশ করলে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে যারাই পদযাত্রার আহ্বান করেছে তাদের বিরুদ্ধে উপরোলিস্নখিত নির্দেশকের আলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে অধিকাংশের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ, দায়িত্ব পালনের সময়ে দায়িত্বহীনতার চিত্র তুলে ধরা, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সখ্যতা, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিত্বে আনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রভূত অভিযোগ থাকায় আহ্বানকারীদের ডাকে পদযাত্রা আন্দোলন খেই হারিয়ে ফেলছে। এ বিষয়গুলো আহ্বানকারীদের স্পষ্ট করতে হবে, এ সংক্রান্তে তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করা জরুরি।

আন্দোলনের আহ্বানকারীদের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের বিষয়বস্তু পদযাত্রা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে থাকে। বিষয়বস্তু নির্ধারণের পূর্বে জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, জনগণকে আন্দোলনের দিকে ধাবিত করার মহৌষধ হিসেবে তথা ক্রীড়নক হিসেবে আন্দোলনের থিম অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আন্দোলনের থিম যদি একান্তই কতিপয় রাজনীতিবিদদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে, বিদেশি বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত করে, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও হানাহানির সৃষ্টি করে, আগুন সন্ত্রাসের আবির্ভাব ঘটায় তাহলে সাধারণ জনতার তাতে কোনো ধরনের সংশ্লেষ থাকবে না, সংশ্লেষ ঘটবে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধারের মনোবাসনায়, সাধারণ জনতাকে ব্যবহারের অপকৌশল হিসেবে।

এখনো বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, যাদের সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এককথায় সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে পদযাত্রা আন্দোলন কখনো আলোর মুখ দেখবে না। বুদ্ধিজীবীরা সরকারের ওপর যেমন চাপ সৃষ্টি করতে পারে তেমনিভাবে জনগণের ওপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এ শ্রেণির সুশীল ও শিক্ষিত মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন এবং সহযোগিতা ব্যতীত পদযাত্রা কখনোই আলোর মুখ দেখবে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আহূত পদযাত্রায় বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন না থাকায় সাধারণ জনতাও এ ধরনের পদযাত্রা থেকে তাদের নিজেদের সম্পৃক্তায়ন বিরত রেখেছে। এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আহ্বানকারীদের পদযাত্রা আহ্বান করা প্রয়োজন, অন্যথায় পদযাত্রা নামমাত্রই পদযাত্রা হয়ে থাকবে।

সম্মানিত পাঠক আপনারাই নির্মোহভাবে দেখেন, চলমান সময়ে যে সব পদযাত্রার বিষয়ে অবতারণা করা হয়েছে কিংবা পদযাত্রাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে কি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল? প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না, আবার যে রাজনৈতিক দলটি পদযাত্রার ডাক দিয়েছে ওই দলটির সদস্যরাই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেনি। সে কারণেই পদযাত্রার যে বিষয়বস্তু তৎবিষয়ে সাধারণ জনতার সমর্থন পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, পদযাত্রার বিষয়বস্তু এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে প্রত্যেকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, সহমর্মিতার জায়গায় প্রত্যেককেই শামিল হতে হয়। তবেই পদযাত্রায় কাঙ্ক্ষিত জনসমর্থন আশা করা যাবে এবং কাঙ্ক্ষিত জনসমর্থন ব্যতীত কখনো পদযাত্রা সফল হবে না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী পদযাত্রা হওয়া জরুরি সেটি কি আমরা করতে পেরেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যে প্রতিবাদের ভাষা উঠেছিল তা পরবর্তী সময়ে সারাদেশে স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সব পেশা শ্রেণির মানুষের জনসমর্থন ছিল তাতে; এ কারণেই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে এবং এখনো অনেকের বিচার চলছে। পদযাত্রার আন্দোলনকে মানুষের ব্যক্তিগত দাবিতে পরিণত করতে হবে, না হলে কোনো যাত্রায় সফল হবে না, অন্ধকারের কালো আঁধারে পতিত হয়ে যাবে পদযাত্রার আবেদন।

কাজেই সমকালীন রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের উচিত হবে সাধারণ জনতার প্রত্যাশাকে উপলব্ধি করে যুগোপযোগী উপায়ে কর্মসূচি প্রণয়ন করা। যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবতার মিশেলে কর্মসূচি প্রণয়ন করে সাধারণ জনতাকে এক কাতারে নিয়ে আসা জরুরি। সব পেশা শ্রেণির সমন্বয়ের বাইরে এসে পদযাত্রার বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার জনগণ যদি এটি বুঝতে পারে, আপনি কিংবা আপনার সমর্থিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণার অংশ হিসেবে লবিষ্ট নিয়োগ করেছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আপনারা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন কিংবা পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ বন্ধে যারা কাজ করেছে; আপনার সমর্থিত রাজনৈতিক দল পরোক্ষভাবে হলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে, তাহলে কিন্তু আপনার দলের আহ্বানে কেউই সাড়া দেবে না। তবে এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতে হবে- পদযাত্রার আবেদন কিন্তু রয়েছে। কেননা, পদযাত্রার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ও যৌক্তিক দাবি দাওয়াকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা যায় এবং জনগণকে তাতে সম্পৃক্ত রাখা যায়।

তবে পদযাত্রাকে বাস্তবায়নের নিমিত্তে রাজনৈতিক দলগুলোকে কতিপয় কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা থাকলে পদযাত্রা আহ্বান করা কখনোই সমীচীন হবে না। সে কারণেই রুট লেভেলে কাজ শুরু করতে হবে- জনমতের স্বার্থে, দেশের প্রত্যেক জায়গায় এ ব্যাপারে আলোচনা চলমান রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলের সহযোদ্ধাদের সমন্বয়ে উপজেলা ও জেলাভিত্তিক কমিটি প্রণয়নের মাধ্যমে পদযাত্রা আহ্বানের বাস্তবতাকে জারি রাখতে হবে। আর যদি রাজনৈতিক দলের জনতার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়, কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্বের সৃষ্টি হয়, তাহলে কেন্দ্রীয়ভাবে পদযাত্রা আহ্বানের কোনো মানে হয় না। কারণ তাহলে পদযাত্রা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

দলীয়ভাবে পদযাত্রা আহ্বান করার পূর্বে দলটির উচিত মানুষের দ্বারে দ্বারে যেয়ে মানুষের প্রত্যাশা, প্রাপ্তির সম্মেলনে গ্যাপসমূহ বের করে মানুষের কল্যাণে রাজনীতি নির্ভর কর্মসূচি প্রণয়ন করা। কিন্তু জনগণ থেকে বিচু্যত হয়ে রাজনীতির মাঠে কোনো কর্মসূচি সফল করার নজির এ দেশে নেই।

\হতবে সংগ্রামী জনতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সেনাশাসক সৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। সংগ্রামী জনতাকে পাশে রাখতে চাইলে জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করতে হবে। কিন্তু আপনার রাজনীতি যদি হয় ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে, দেশদ্রোহীদের সঙ্গে, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তাহলে আপনাকে কিংবা আপনার সমর্থিত রাজনৈতিক দলকে এ দেশের মুক্তিকামী জনতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে এবং এ ধরনের নজির জনগণ বারবার দেখিয়েছে। সুতরাং, রাজনীতিবিদদের উচিত হবে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের মর্জি মোতাবেক দল পরিচালনা করে রাষ্ট্রের যে কোনো দুর্বিপাকে জনগণের ইচ্ছানুযায়ী কর্মসূচি প্রণয়ন করা।

মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে