শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভূগর্ভস্থ পানির সংকট

পানিঘটিত সমস্যার স্বরূপ যাই হোক না কেন, সবই পরিবেশ বিপর্যয়ের সাক্ষ্য বহন করে। জলবায়ু পরিবর্তন তথা পরিবেশিক ভারসাম্যহীনতার সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবিলা বিশ্বমানবের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও সমস্যাটি প্রকট। বলার অপেক্ষা রাখে না, সমস্যাটিকে প্রবল করে তুলেছি আমরা নিজেরাই। পানির স্তর অস্বাভাবিক মাত্রায় নিচে নেমে যাওয়ার একটি বড় কারণ ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন।
আর কে চৌধুরী
  ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

দেশের উত্তরাঞ্চলে খরা প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার এবং ভূগর্ভে পানির প্রবেশ ব্যাহত হওয়ায় পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। অনেক এলাকায় নলকূপে পানি উঠছে না। বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ দিয়ে মাটির নিচ থেকে দিনরাত অবিরাম পানি তোলা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা দুই দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ, যার ফলে আমরা গুরুতর সংকটে পড়ে যেতে পারি।

প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। উভয় প্রকার ঝুঁকির কথা আমাদের সবারই জানা আছে। সে জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয় সব দেশেই।

অন্যদিকে, দক্ষিণাঞ্চলেও স্বাদু বা মিঠা পানির অভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। মানুষ বাধ্য হয়ে ক্ষতিকর পর্যায়ে থাকা নোনা পানি পান করছে। ভূগর্ভেও নোনা পানির অনুপ্রবেশ বাড়ছে। ফসল, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লবণ শরীরে প্রবেশ করায় মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত করার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় নিচু ভূমি ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। সুপেয় পানির অভাব তীব্র হচ্ছে। এর সবই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে। খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুরের পানিতেও মাত্রাতিরিক্ত লবণ। বাগেরহাট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্য মতে, প্রতি লিটার পানিতে লবণাক্ততার গ্রহণযোগ্য মাত্রা এক হাজার মিলিগ্রাম হলেও মোংলায় প্রতি লিটার পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া যায় চার থেকে সাড়ে ৯ হাজার মিলিগ্রাম পর্যন্ত। অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে ৯ গুণ বেশি। এসব পানি পান করে মানুষ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, পেটের পীড়াসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ছে। এই চিত্র শুধু বাগেরহাট নয়, সাতক্ষীরা, খুলনাসহ পুরো উপকূলীয় অঞ্চলের।

অন্যদিকে, দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়ার অনেক আলামতই দৃশ্যমান হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি অত্যধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হলেও বৃষ্টির পানি যথেষ্ট পরিমাণে ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারছে না। তাই দ্রম্নত নামছে ভূগর্ভের পানির স্তর। পানির স্তর দক্ষিণাঞ্চলেও নামছে। সেখানে পানির এই শূন্যস্তর পূরণ করছে নোনা পানি। ফলে ভূগর্ভে নোনা পানির এই বর্ধিত উপস্থিতি ক্রমে দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে, তা না হলে চরম বিপর্যয় দেখা দেবে। এ থেকে রক্ষা পেতে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমাতে হবে, ভূগর্ভে পানির অনুপ্রবেশ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে এবং জলাধার ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সরবরাহ বাড়াতে প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার লাগসই প্রযুক্তিগুলোর উন্নয়নে জোর দিতে হবে।

একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশে কৃষিকাজে প্রায় ১৭ লাখ টিউবওয়েল ব্যবহার করা হয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও নগরকেন্দ্রিক মানুষের জন্য সারাদেশে প্রায় ১২ লাখ টিউবওয়েল স্থাপন করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। এর বাইরে যেসব অগভীর নলকূপ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ অচল (পানি পাওয়া যায় না)।

নাসার মতে, পৃথিবীর ৩৭টি বৃহৎ পানির স্তরের মধ্যে ২১টির পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ স্তরগুলোর অবস্থান ভারত ও চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সীমানার মধ্যে। নাসা ১৩টি পানির স্তরকে আখ্যায়িত করেছে চরম সংকটাপন্ন স্তর হিসেবে, যেগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। এ স্তরগুলো ব্যবহার উপযোগী করা অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপায়ে স্তরগুলো পানিতে পরিপূর্ণ করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পানির স্তর নিচে নামার বিপদ থেকে নদনদীর দেশ বাংলাদেশও মুক্ত নয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই পানির স্তর দ্রম্নত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নামছে নিচের দিকে। ওয়াসা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে পানি উত্তোলনে বাধ্য হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীর নদীগুলোর পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে পড়ায় তা পরিশোধন করে ব্যবহার করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর যে বাড়তি চাপ পড়ছে তা অশনিসংকেত বলে বিবেচিত হচ্ছে। রাজধানীর পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় বিপদ সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিক থেকেও। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগের দূষিত পানি ভূগর্ভের শূন্য স্থানে প্রবেশ করে নাগরিক জীবনের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারকারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে। বাংলাদেশ যে পানির সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে তার প্রধান কারণ উজানে পানি প্রত্যাহারের ঘটনা। নদনদীর পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাসও এ বিপদের জন্য দায়ী। নদী দূষণ অবস্থাকে ভয়াবহভাবে বিপজ্জনক করে তুলছে। অস্তিত্বের স্বার্থে উজানে পানি প্রত্যাহার রোধে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। নদনদীর ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো ও দূষণ বন্ধে নিতে হবে পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে কোথাও হেলাফেলা কাম্য নয়।

চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে হাজার হাজার নলকূপ বিকল, পানি নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। এর প্রধান কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। চট্টগ্রাম ও খুলনা বলে কথা নয়, আসলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নেমে যাওয়ার সমস্যাটি কমবেশি সারা দেশের। বর্ষাকালে সমস্যাটি বোঝা না গেলেও শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছরই খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি উত্তরাঞ্চলে। দক্ষিণাঞ্চলে সমস্যার স্বরূপ ভিন্ন। সেখানে অতিমাত্রায় লবণাক্ততার কারণে খাবার পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায় নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের বিষ। পানিতে স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিক খুব একটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এটা যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন সে পানি মারাত্মক স্বাস্থ্যহানিকর। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করার ফলে দেখা দেয় আর্সেনিকোসিস রোগ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য মানুষ আজ এই রোগের শিকার।

খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ব্যবস্থাকে আমরা করে তুলেছি প্রধানত সেচনির্ভর। নদী ও খালে পানি না থাকায় পাওয়ারপাম্পে সারফেস ওয়াটার সেচ এখন নেই বললেই চলে। নদী ও খাল-বিলের পাড়েও বসেছে গভীর নলকূপ। খাবার পানিও উঠছে গভীর নলকূপে অথবা সাবমার্সিবল পাম্পে। এতে চাপ পড়ছে মাটির নিচের পানির স্তরে। এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার পথ একটাই, নদীসহ খাল ও অন্যান্য জলাশয়ে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে