সোমবার, ২৬ মে ২০২৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নতুন শিক্ষাক্রম কোথায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে?

আরফাতুর রহমান শাওন
  ০২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
নতুন শিক্ষাক্রম কোথায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে?
নতুন শিক্ষাক্রম কোথায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে?

শিক্ষাক্রম যে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থাকে পথ দেখায়। সঠিক পথই শিক্ষার রূপ দিতে পারে। শুধু তাই নয়, মানুষের মত মানুষ হতেও পরিপূর্ণতা লাভ করে। একটি জাতি তখনই আলোর মুখ দেখে যখন সঠিক শিক্ষানীতি মুখ থুবড়ে না পড়ে। বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম চলতি বছরে নতুনরূপে পাঠদানে ভূমিকা রাখছে। শুধু তাই নয়, গত বছর পাইলটিং হয়েছে কিছু বিদ্যালয়ে। প্রাপ্ত ফলাফল ও উপাত্তের ভিত্তিতে চলতি বছরে শিক্ষা রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে।

গত বছরে পাইলটিংয়ের তথ্য-উপাত্ত কি সবার সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছিল। উত্তরে না, যদি সবার সঙ্গে শেয়ার করা যেত তাহলে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যেত। নতুন কারিকুলামের পঠন প্রক্রিয়া কেমন হবে? তা নিয়ে বছরের শুরু থেকেই একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের শুরু হয়। শিক্ষকরা বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা রপ্ত করবে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রতিটি শিখন অভিজ্ঞতা।

1

ইতোমধ্যে ষান্মাসিক সামষ্টিক মল্যায়ন সমাপ্ত হয়েছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নির্দেশনা ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের কয়েকদিন আগে হাতে আসে। তাই যথার্থ সময় না পেয়ে শিক্ষার্থীরা মূল্যায়নে কিছুটা হযবরল হয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশ শিক্ষক এখনো পরিষ্কার নন, নতুন শিক্ষাক্রম প্রসঙ্গে। শ্রেণি কার্যক্রমে তারা এখনো গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছেন। অধিকাংশ শিক্ষার্থী জানেই না তারা চূড়ান্ত মূল্যায়নের দিনে কি কার্যক্রম করাবে। এতে অভিভাবকরা নেতিবাচক বিচার-বিশ্লেষণ করা শুরু করে দিয়েছেন, যা নতুন কারিকুলামের প্রধান অন্তরায় বলে বিবেচিত হচ্ছে। আর যেসব শিক্ষক নির্দেশনা যথার্থ অনুসরণ করছেন তাদের কাজের প্রশংসা তো দূরে থাক, তাদের কাজ নিয়ে অনেক শিক্ষকই হেয়-তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে কর্ণপাত করছেন না।

শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলামে ব্যবহারিক উপকরণে খরচের চাপে পড়ছে। তা দরিদ্র পরিবারের পক্ষে কষ্ট সাধ্য হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক নির্দেশনায় স্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে কোনো উপকরণের জন্য যেন শিক্ষার্থীরা আর্থিক চাপে না পড়ে। বাস্তব চিত্র তার উল্টো। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে উপকরণের খরচ শিক্ষার্থীর ঘাড়ে ফেলছে।

অভিভাবকরা এখনো বুঝতে পারছে না তাদের সন্তানরা বিদ্যালয়ে কি পাঠ রপ্ত করছে। বলা চলে অধিকাংশ অভিভাবক একটা ত্রম্নটিপূর্ণ ধারণা ধারণ করে আছেন। আমরা শিক্ষকরাই তাদের নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি করছি। একটা উদারণের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যাক, শিক্ষকদের একটা গোষ্ঠী যারা প্রাইভেটের সঙ্গে যুক্ত তারা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার সময় নতুন কারিকুলামের ইতিবাচক বিষয়গুলো না তুলে ধরে নেতিবাচক বিষয় উপস্থাপন করছেন। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, প্রাইভেট থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা গতানুগতি শিক্ষাকেই বেশি ভালো বলে প্রচার চালাচ্ছেন।

বিদ্যালয়ের পরিবেশগত সমস্যাও নতুন কারিকুলামের অন্তরায়। শুধু তাই নয়, যোগ্য শিক্ষক না থাকায় এই কারিকুলামের আলোর মুখ দেখতে পারছে না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ঠিক দেওয়া হচ্ছে কিন্তু বিদ্যালয়ে তার ছিটেফোটাও দেখা যাচ্ছে না। তারা নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণের জন্য যেমন অস্থির ও আগ্রহী কিন্তু বাস্তবে ক্লাসে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ততটা উদাসীন।

অধিকাংশ বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের দলগত কাজের জন্য বসার ব্যবস্থা একদম অপ্রতুল্য। অর্থ্যাৎ কিছু কিছু শ্রেণিকক্ষ একদম শঙ্কীর্ণ ও ছোট। যা কার্য পরিচালনায় ব্যাঘাত দেখা দিচ্ছে। তাছাড়া একই দিনে অনেকগুলো বিষয়ের অনুসন্ধানী ও তথ্য যাচাই-বিশ্লেষণে কাজগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য চাপের সৃষ্টি করছে। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষার্থী প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারও করতে পারছে না। শহুরে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেও শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি থাকায় এবং বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকায় তা ভালোভাবে প্রদান করা যাচ্ছে না।

নতুন শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় বাধার কারণ হচ্ছে অধিকাংশ শিক্ষক টিজি অর্থাৎ শিক্ষক সহায়ক নির্দেশিকা অনুসরণ না করেই মনগড়া পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে শিক্ষাক্রমের বাস্তব রস থেকে শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে ক্লাসের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনীহা দেখা যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো কার্যক্রম বিদ্যালয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে অনুশীলন করা এবং সব শিক্ষার্থীর অভিন্ন মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বিশেষায়িত বিষয়গুলোর যৌক্তিক সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করতে হবে।

অনেক বিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে, এনসিটিবি মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ না করে গতানুগতি পরীক্ষার মাধ্যমে ষান্মাসিক পর্ব শেষ করেছে। ফলে শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সামগ্রিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাই ত্রম্নটির মধ্যেই থেকে গেল।

নতুন শিক্ষাক্রমের আর একটি বিশেষ বাধা হচ্ছে বইয়ের ভাষা কিছুটা জটিল। শিক্ষার্থীদের বয়সভেদে বইয়ের ভাষা তেমন সহজ ও সাবলীল হয়নি। বইয়ের ভাষা সহজ, সরল ও সাবলীল হলে শিক্ষার্থীরা আগ্রহের সঙ্গে পড়তে উৎসাহিত হবে। তাছাড়া বইয়ে অনুশীলন চর্চার সুযোগ রাখতে হবে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি অনুশীলনীর কাজগুলো যথার্থ করালে বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে। শুধু দলগত কাজে চাপ দিলেই হবে না, একক কাজও তাদের জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে। ক্লাসের পিরিয়ড কমিয়ে সময় বৃদ্ধি করলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষণ পূর্ণতা পাবে।

অভিভাবকদের দৃষ্টি ইতিবাচক করার লক্ষ্যে শিক্ষকদেরই ভূমিকা নিতে হবে। সামাজিক গণমাধ্যমে নতুন কারিকুলামের কার্যক্রম বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। প্রয়োজনে অভিভাবকদের ক্লাস চলাকালীন বিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং তাদের সন্তানরা কি শিখছে তা অনুধাবনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষয় শিক্ষক অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন, যেন তারা শিখন কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত হন। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের কাজে অভিভাবকদের সহযোগিতা পাবে।

নতুন কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানভিত্তিক একটি রূপরেখা। তাই এর বাস্তবায়নের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকাই উত্তম। কারণ যৌক্তিক গবেষণা ফলশ্রম্নতি নিয়েই এটি সাজানো হয়েছে। একটু তো সময় লাগবেই প্রতিটি স্তরে খাপ খাওয়াতে। তাই ধৈর্য ধরে আগাতে হবে, একটি গতানুগতি পরিবেশকে পেছনে ফেলতে সময় লাগবে। নেতিবাচক মনোভাব না নিয়ে ইতিবাচকভাবে সামনে আগালেই দেখা যাবে নতুন শিক্ষাক্রম আসলেই কি আমাদের বাংলাদেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পেরেছে কিনা!

আরফাতুর রহমান শাওন

শিক্ষক

মিলস্নাত উচ্চ বিদ্যালয়, বংশাল, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে