শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

মীমাংসিত জাতীয় ইসু্য এবং অমীমাংসিত রাজনীতি

আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মুখ্য উদ্দেশ্যের একটি ছিল স্বাধীনতা লাভ, যা বাংলার জনগণ ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছে। আমরা এখন বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ভূখন্ডের নাগরিক, ১৯৭১ পরবর্তী প্রজন্মরা মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরি সন্তান। প্রসঙ্গত মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিল বাঙালি জাতির নানাবিধ বৈষম্য ও শোষণ নিরসনে আর্থ-সামাজিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি ইত্যাদি। আর সেসব কাঙ্ক্ষিত মুক্তির জন্য প্রয়োজন নাগরিকের মেধার ক্রমবিকাশ, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন, কুসংস্কার ও যাবতীয় পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার অবসান, যা আমাদের দেশ ও জাতির উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত।
আহম্মেদ কামরুল মোর্শেদ এবং মো. মজিবুর রহমান
  ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
মীমাংসিত জাতীয় ইসু্য এবং অমীমাংসিত রাজনীতি

আসন্ন জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের নাগরিকরা আজ দ্বিধাবিভক্ত অবস্থায় পরস্পর সাংঘর্ষিক একটি সংকটময় অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের উত্থাপিত কিছু জাতীয় ইসু্যর কার্যকর মীমাংসা ব্যতীত শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা দ্বারা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনা সম্ভবপর নয় বলে মনে করি। কারণ নির্বাচনে বিজয়ী দল তাদের নিজস্ব দলীয় মতাদর্শকেই কেবল একচেটিয়াভাবে প্রাধান্য দেবে এবং পরাজিতরা সর্বান্তকরণে বিজয়ীদের বিরোধিতায় লিপ্ত হবে। সুতরাং, চলমান এই অনিষ্টকর সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধারকল্পে জাতীয় ইসু্যভিত্তিক দাবিনামা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মুখ্য উদ্দেশ্যের একটি ছিল স্বাধীনতা লাভ, যা বাংলার জনগণ ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছে। আমরা এখন বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ভূখন্ডের নাগরিক, ১৯৭১ পরবর্তী প্রজন্মরা মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরি সন্তান। প্রসঙ্গত মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিল বাঙালি জাতির নানাবিধ বৈষম্য ও শোষণ নিরসনে আর্থ-সামাজিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি ইত্যাদি। আর সেসব কাঙ্ক্ষিত মুক্তির জন্য প্রয়োজন নাগরিকের মেধার ক্রমবিকাশ, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন, কুসংস্কার ও যাবতীয় পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার অবসান, যা আমাদের দেশ ও জাতির উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত।

\হকিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও জাতীয় এবং সামাজিক বিভিন্ন ইসু্যতে সমষ্টিগতভাবে দেশের উন্নয়নে আমরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধভাবে সম্পৃক্ত না করে বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ ও সংরক্ষণের হিস্যা নিয়ে লজ্জাস্করভাবে এখনো বিবাদে লিপ্ত রয়েছি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম উদ্দেশ্য প্রতিটি নাগরিকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জনে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে আমরা ক্রমাগতভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য, সামাজিক বৈষম্য নিরসন, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক সাংস্কৃতিক মুক্তির এজেন্ডাকে গুরুত্ব না দিয়ে মুক্তিসংগ্রামে খন্ডিত অবদান ও ভূমিকা বেষ্টিত বিতার্কিক ইতিহাসের এজেন্ডাকে অধিক বিবেচনায় নিয়ে সমৃদ্ধশালী জাতি, রাষ্ট্র গড়ার দৌড়ে আমরা বারবার পিছিয়ে পড়ছি, যা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত।

এরূপ পরিস্থিতিতে দেশের সামষ্টিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইসু্যতে আমাদের দৃঢ় ঐকমত্য স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে দেশের উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের সন্তানদের দেশপ্রেম বোধ স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত থেকে যাবে। আর সম্ভাবনাময় জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখাটাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে সব সময়ই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য।

প্রসঙ্গত সমৃদ্ধশালী দেশ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরিতে নীতিবাক্য দ্বারা গণতন্ত্রের ভিতকে শক্তিশালী করা কিংবা অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতাই শুধু যথেষ্ট নয়। বহির্বিশ্বের অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির যাঁতাকল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বৃহত্তর জাতীয় ইসু্যতে দৃঢ় ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথার নির্ভুল ইতিহাস, মুক্তিসংগ্রামের চেতনা ও গৌরবময় নেতৃত্ব, সংবিধানিক মূলনীতিগুলো, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও স্বাধীনতার ঘোষক, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা 'জাতির পিতা', জাতীয় স্স্নোগান 'জয় বাংলা', বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুজিবনগর সরকার গঠন ইত্যাদি প্রসঙ্গে জনতা, এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে মীমাংসিত ও সংবিধান স্বীকৃত বিষয়ে এক শ্রেণির নাগরিকের অনাকাঙ্ক্ষিত অনৈক্য ও ভিন্নমত জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে, যার জন্য আমাদের কাঙ্ক্ষিত আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন আজ প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাধীনতার পরবর্তী ৫২ বছরেও ওইসব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইসু্যগুলোতে বিতর্কের সর্বসম্মত কোনো কার্যকর সমাধান না করে (প্রায়োগিক অর্থে) উদ্দেশ্যমূলকভাবেই জাতীয় চেতনা এবং দেশের নাগরিক ঐক্য ও শক্তিকে দুর্বল করা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষের চক্রান্তে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সন্তান মেধাবী ও শিক্ষিত নতুন প্রজন্মকে দাবিয়ে রাখতে এক অপকৌশলের রাজনীতিকে জিইয়ে রেখে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে এসব বিতর্ককে অব্যাহত রাখা হয়েছে। ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ওইসব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইসু্য ও মৌলিক বিষয়ে একটি দলকানা অবস্থায় নিজেদের আলাদা আলাদা চিন্তা, বিভেদ ও মনোভাব পোষণে বড় হওয়ায় তাদের হৃদয়ে দেশপ্রেম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শাণিত হচ্ছে না। সময়ের দাবি পূরণে এ বিভেদ ভাঙতে হবে, নতুন প্রজন্মকে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সত্য উপহার ও জানতে দিয়ে এসব নিয়ে অপরাজনীতি বন্ধ করা জরুরি। আমাদের রাজনীতির বিষয় এবং উদ্দেশ্য হোক দেশ পরিচালনার জন্য উন্নত মেধার বিচক্ষণ ও সৎ নেতৃত্ব নির্বাচন, নাগরিকদের মেধা ও শক্তির বিকাশ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক বৈষম্য নিরসনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক কলা-কৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন; শিল্প, সাহিত্যে উন্নয়নের মাধ্যমে সাংস্কৃতি বিপস্নব ঘটানোর সামর্থ্য অর্জন এবং সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার নীতি ও শক্তি বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। গয়রহভাবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নয়, বরং প্রয়োজনে আরও একধাপ এগিয়ে আমাদের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। তবেই হবে জাতির প্রকৃত উন্নতি।

উপর্যুক্ত প্রেক্ষিতে বিজ্ঞজনরা মনে করেন যে, বর্ণিত দ্বান্দ্বিক অবস্থানের কার্যকর নিরসনে দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর কাছ থেকে ইতোমধ্যেই মীমাংসিত সুনির্দিষ্ট জাতীয় বিষয়াবলি প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে ঐকমত্যের অঙ্গীকার আদায়ের এখনই উপযুক্ত সময়। সুতরাং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের উচিত হবে সব রাজনৈতিক, সামাজিক দল-গোষ্ঠীকে জাতীয় ওইসব গুরুত্বপূর্ণ ইসু্যতে মনন ও চিন্তায় সংহতি পোষণের মাধ্যমে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের কাজ প্রত্যক্ষভাবে শুরু করা। দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার সংস্কৃতি চর্চা ও লালন করা। আমাদের পবিত্র সংবিধান ও মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাস, জাতীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা। গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মতাদর্শের দল, গোষ্ঠী ও নাগরিকদের সুচিহ্নিত করে তাদের প্রতি সম্মিলিতভাবে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জাতীয় ঐক্যবোধ, দেশপ্রেম, সভ্য নাগরিক বৃদ্ধিতে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সমুন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা। আমরা জানি যে, যে জাতি যতটা আইন মানে, সে জাতি কার্যত ততটাই সভ্য।

যা হোক তাৎক্ষণিকভাবে নিম্ন্নবর্ণিত জাতীয় ইসু্যসমূহে দলমত নির্বিশেষে ঐকমত্য স্থাপন করা চলমান সময়ের প্রেক্ষিতে একান্ত আবশ্যক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিসংবাদিতভাবে আমাদের 'জাতির পিতা'। (সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৪ এ)

ঐতিহাসিক সূত্রেই 'জয় বাংলা' বাঙালির জাতীয় স্স্নোগান। (সুপ্রিম কোর্টের রায়)

মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলার আম্র্রকাননে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত অস্থায়ী সরকারের অধীনে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে যৌক্তিকভাবে গর্বের স্বাধীনতা অর্জন করেছে, এটা জাতির বীরত্বগাথা চির অমলিন একটি ইতিহাস।

সন্দেহাতীত কারণেই স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। (সুপ্রিম কোর্টের রায়)

সুদীর্ঘ মুক্তি-সংগ্রামের অঙ্গিকার হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, অর্থাৎ জাতিসত্তা হিসেবে আমরা বাঙালি। তবে একজন নাগরিক হিসেবে আমরা অবশ্যই বাংলাদেশি নাগরিক। (সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯)

'বঙ্গবন্ধু' জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের উপাধি বা খেতাব। (সংবিধান স্বীকৃত অনুচ্ছেদ-৪ এ)

সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন। ( সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৮)

উপর্যুক্ত জাতীয় ইসু্যসমূহের প্রসঙ্গে বিতর্ক করার সুযোগ কার্যকরভাবে রহিত হলে যেমন জাতীয় রাজনীতির গুণগত বিশাল পরিবর্তন সাধিত হবে এবং দেশ ও জাতির জন্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নেই জাতীয় রাজনীতির গতিপথ প্রধানত বৃত্তবন্দি থাকবে। মেধাবী তরুণরাও রাজনীতিতে উৎসাহিত হবে।

আহম্মেদ কামরুল মোর্শেদ : লেখক ও গবেষক এবং মো. মজিবুর রহমান :আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে