সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আধিপত্যবাদী চিন্তা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়

মেহেদী হাসান বিপস্নব শিক্ষার্থী দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
  ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আধিপত্য হচ্ছে গ্রিক ভাষায় হেগেমন থেকে উৎপন্ন। যা ইংরেজি হেজিমনির বাংলা প্রতিশব্দ। প্রত্যয়টির অর্থ জটিল। দুটি বিপরীত অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। একটির অর্থ হলো জবরদস্তিমূলক আধিপত্য। অপরটি নেতৃত্ব, যার ভেতরে সম্মতি প্রচ্ছন্ন থাকে। কোনো শ্রেণি বা রাষ্ট্রের দ্বারা অন্যান্য শ্রেণি বা রাষ্ট্রের ওপর প্রভুত্ব করাকে আধিপত্য বলা হয়। আর কোনো শ্রেণি বা রাষ্ট্র যারা নিজেদের মধ্যে অন্য শ্রেণি বা রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব বা প্রভুত্ব করার ইচ্ছা বা মনোবাসনা লালন করে, তাদেরই মূলত আধিপত্যবাদী হিসেবে গণ্য করা হয়। যারা আধিপত্যবাদী চিন্তাধারার অধিকারী, তারা কখনো মানবতা, মানবাধিকার, সাম্য, নৈতিকতা ইত্যাদির ওপর স্থির থাকতে পারে না। তাদের চিন্তাধারায় থাকে যেকোনো মূল্যে অন্য শ্রেণি বা রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্য বজায় রাখা। যার জলন্ত দৃষ্টান্ত আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সময় দেখতে পাই। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফিলিস্তিন সংকট। পশ্চিমা আধিপত্যবাদীরা তাদের আধিপত্যকে মধ্যপ্রাচ্যে বজায় রাখার জন্য প্রতিষ্ঠা করে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র। যা মধ্যপ্রাচ্যে বিষধর সাপে পরিণত হয়ে প্রতিনিয়ত শান্তিপ্রিয়, স্বাধীনতাকামী সাধারণ ফিলিস্তিনিদের দংশন করেই যাচ্ছে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্থার জেমস বালাফর ফিলিস্তিন ভূখন্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর ইউরোপ থেকে বিপুলসংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনে এসে বসবাস শুরু করে। ১৯১৯ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদির সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার। ১৯৩১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে এক লাখ ৮০ হাজার হয়। ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছয় লাখে উন্নীত হয়। এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা এসে ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করতে থাকে। যা এখনো চলমান। পশ্চিমা আধিপত্যবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কর্তৃত্ব বা প্রভুত্বকে দৃঢ করার জন্য ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রকে ইস্ট্যাবলিশ করতে বিভিন্ন কর্মতৎপরতা চালাতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিতকরণ-সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের ৪৫ শতাংশ ভূমি ফিলিস্তিনিদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদিদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটিও ইসরাইল কখনো মেনে নেয়নি। অবশেষে ১৪ মে, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আর পশ্চিমারা বিভিন্নভাবে সামরিক দিক থেকে ইসরাইলকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে তৎপরতা চালাতে থাকে। যা এখনো বিদ্যমান। ইসরাইলের জন্ম, ইতিহাস ও রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই ইসরাইল প্রতিবেশী আরব রাষ্টগুলোর সঙ্গে বেশ কয়েকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু ইসরাইল এখন প্রতিবেশী আরব রাষ্টগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে না জড়ালেও ফিলিস্তিনিদের ওপর অমানবিক জুলুম, নির্যাতন, মানবাধিকার হরণ, নির্বিচারে হত্যাকান্ড ঘটানো (যার মধ্যে অসংখ্য শিশুহত্যা অন্যতম) ইত্যাদি তার জন্মলগ্ন থেকে এখনঅবধি করে যাচ্ছে। যা ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত ৭ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা, নিহত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। এই নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী, শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরী এবং বয়স্ক লোকজন। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৫২ হাজার ৫৮৬ জন এবং এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ছয় হাজার ৭০০ জন।। এ ছাড়া হাজার হাজার পরিবার বাড়িঘর-সহায় সম্বল হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্কুল, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।( ঢাকা পোস্ট, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩)

অথচ ফিলিস্তিনে এত অমানবিক নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচারে হত্যাকান্ড ঘটানোসহ নানা অপকর্মে ইসরাইল লিপ্ত হলেও মানবতার ফেরিওয়ালা, যারা সবসময়ই অন্যান্য ক্ষেত্রে মানবতার বুলি আওড়ান, আশ্চর্যজনকভাবে তারা এখন চুপ, দৃষ্টি থেকেও অন্ধ। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে, তাদের ওই আধিপত্যবাদী চিন্তাধারা মূল কারণে পরিণত হয়েছে। কারণ, পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্যকে বজায় রাখার জন্য সবসময়ই ইসরাইলকে বিভিন্ন দিক থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে। এতে ইসরাইল যত বড়ই অপরাধ করুক না কেন, সেটা তারা বিভিন্নভাবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে এবং করে যাবে। যা বর্তমানে আরও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা জাতিসংঘেরও পরওয়া করছে না। ফলে জাতিসংঘের অসহায়ত্ব এখন দৃশ্যমান।

তাহলে জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এখন অস্বাভাবিক কিছু না। এটাই বাস্তব। আবার অন্যদিকে রাশিয়াও তাদের আধিপত্যকে বজায় রাখার জন্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ইউক্রেনে তুচ্ছ অজুহাতে আগ্রাসন চালাচ্ছে। প্রতিনিয়ত এই রাষ্ট্রটি বড় একটি রাষ্ট্রের পেটে চলে যাচ্ছে। যা কখনই কাম্য নয়। কিন্তু এটা পরিষ্কার, এটার মূলেও ওই আধিপত্যবাদী চিন্তাধারা দায়ী। এভাবেই যদি কোনো শক্তিশালী, বড় রাষ্ট্র কিংবা শক্তিশালী কোনো শ্রেণি তাদের আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিংবা আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ছোট কিংবা সামরিক দিক থেকে দুর্বল কোনো শ্রেণি বা রাষ্ট্রের ওপর আগ্রাসন চালায়, নির্বিচারে হত্যাকান্ড পরিচালনা করে, মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে, মানবতার অকাল মৃতু্য ঘটায়। তাহলে এতে আধিপত্যবাদী শক্তির কোনো যায় আসে না। যা বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এটা তো বিশ্বনেতাদের থেকে কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষ আশা করেনি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বর্তমানে এটাই হচ্ছে। অথচ এসব কর্মকান্ড রোধেই মূলত জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। যা কল্পনাতীত।

সুতরাং, পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষ আজ এসব থেকে মুক্তি চায়। তারা শান্তিপূর্ণ পৃথিবী দেখতে চায়। তারা দেখতে চায়, আধিপত্যবাদীরা তাদের আধিপত্যকে বজায় রাখার জন্য বর্বর যুগে ফিরে না গিয়ে বরং বর্বরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ন্যায় ইনসাফের পক্ষে আসুক। সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ায় ভূমিকা রাখুক। আর জাতিসংঘের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশ্বনেতাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। বর্তমান জাতিসংঘের ভূমিকা হতাশাজনক। তাই জাতিসংঘকে পুনর্গঠন করে শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এমন একটি সংস্থা গড়ে তুলতে হবে, যে সংস্থা দশকের পর দশক ধরে ঝুলে থাকা ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারবে। এ ছাড়াও চলমান ও আগত সব সংকট সমাধানে সর্বদা তৎপর থাকবে। তবেই পৃথিবী থেকে আধিপত্যবাদী, ভূমিখেকো, জুলুম-নির্যাতন, মানবতাহীন কর্মকান্ড ইত্যাদির চিরতরে পরিসমাপ্তি ঘটবে। নতুবা এই আধিপত্যবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটবে। পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ছড়িয়ে পড়বে। আধিপত্যবাদীরা ফিলিস্তিনের মতো পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে তাদের আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য বর্বরতার পথ বেচে নিবে। ফলে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। একপর্যায়ে পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হবে। এটা বলাইবাহুল্য। যা আমরা কখনো প্রত্যাশা করি না।

অতএব, বিশ্ববাসীকে অবশ্যই আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। বিশ্বনেতাদের চলমান সংকট শান্তিপূর্ণ সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, একটি সংকট নানা সংকটের জন্ম দেয়। তাই আসুন, আধিপত্যবাদকে না বলি, শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে