সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণ ও আমাদের পর্যটনশিল্প

শাহ আরুফা জাফনা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস (বিইউপি)
  ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

২০১৮ সালে পরিবারের সবাই মিলে কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সুন্দর সমুদ্র সৈকত, লঙ্ঘিনী সুন্দরী দ্বীপ এবং দীর্ঘক্ষণ সূর্যাস্তের দৃশ্য সবই মনোমুগ্ধকর। অথচ প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্য আজ দূষিত হচ্ছে পর্যটকদের যত্রতত্র অপচনশীল পলিথিন, পস্নাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি ফেলার কারণে। দেশে অবকাশকালীন ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের শীর্ষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে- কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি। এ কারণে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিনিয়োগও সেখানেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আবার সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির সীমাবদ্ধতায় এসব এলাকায় পরিবেশগত ক্ষতিও হয়েছে মারাত্মক আকারে। শুধু তাই নয়, গোটা দেশেই বনাঞ্চল, জলাভূমি, পার্বত্যাঞ্চল ও সাগরসৈকতকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলো দূষণ ও প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ ভ্রমণ স্থানে নেই ডাস্টবিন। ফলে পর্যটকদের ফেলে দেওয়া পস্নাস্টিকের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। দিগন্তজুড়ে সবুজের পটভূমি, বাংলার ভূখন্ডের বুক চিড়ে ছুটে চলা অসংখ্য ছোটবড় নদী, পূর্ব সীমান্তের পাহাড়ের সৌন্দর্য্য, দক্ষিণের ম্যানগ্রোভ বন ও সমুদ্র সৈকত, বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ও হাজার বছরের ইতিহাসের বাহক পুরাকৃর্তি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বিষ্মিত ও বিমোহিত করে। রোমাঞ্চকর পর্যটনের জন্য সেরাদের তালিকায় অন্যতম পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঝর্ণাসমূহের ট্রেকিং ও হাইকিং, সুন্দরবনের রোমাঞ্চ, কাপ্তান হ্রদে মাছ শিকার ও সমুদ্রতীরে ঝাউবনে তাঁবুবাস পর্যটকের রোমাঞ্চিত ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে তুলে। এ ছাড়াও, বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পর্যটনকেন্দ্রগুলো মধ্যে অন্যতম ঢাকার লাগবাগ দুর্গ, কুমিলস্নার ময়নামতি, পাহাড়পুর বিহার, সোনারগাঁয়ের পানাম নগর, মহাস্থান গড়, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় জাদুঘর এবং বাঙালি জাতির রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার পর্যটকদের আনাগোনায় সারা বছর মুখরিত থাকে। অথচ দেশের প্রধান পর্যটন অঞ্চলগুলোর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যই আজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবেশ অধিদপ্তর বর্তমানে মোট ১৩টি স্থানকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। দিন দিন এসব পর্যটন এলাকা প্রতিবেশগতভাবে আরও বিপন্ন হয়ে পড়ছে, যা এসব এলাকায় টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পিছিয়ে। স্বাধীনতার পর ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের পর্যটনশিল্প এগোয়নি। মুন্ডির্ যাংকিং মতে, পর্যটনশিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম, আর এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যে ৪২তম। মুন্ডির্ যাংকিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে ছয়টি এবং এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত হিসেবে পর্যটন শীর্ষে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২০০ মিলিয়নে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্য বলছে, দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৩ দশমিক ০২ শতাংশ, আকার ৭৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পর্যটনশিল্প থেকে ১০ শতাংশ জিডিপি অর্জন করা সম্ভব। এ ছাড়া বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে ঘিরে বহু বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়েছে। পর্যটন বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বাংলাদেশ পর্যটন ব্যালান্স শিটের দায়বদ্ধতার পাতায় দেখা যায় এই শিল্প আসলেই বেশকিছু ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে রসদ জোগাচ্ছে। পর্যটনশিল্পে অন্যান্য শিল্পের চেয়ে পানির খরচটা বেশি হয়। পর্যটন স্থানীয় মানুষের খাদ্য, এনার্জি ও অন্যান্য কাঁচামালের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আসলে পর্যটনকে নয়, বরং পর্যটকদের আচার-আচরণ ও ব্যবহারবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন এবং এ জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের। কিন্তু বাংলাদেশের পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত ১৫-১৬টি আইন ও নীতিমালা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত ধারা খুঁজে পাইনি, যেখানে পর্যটকদের আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা রয়েছে। পর্যটনশিল্প জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাই দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এ জন্য পর্যটনশিল্প বিকাশের জন্য সুন্দর, দূষণমুক্ত, গুণগত মানসম্পন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন। বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পে বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। এ জন্য পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবপক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এই শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটনশিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে সঠিক পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বর্তমানে সরকার সুন্দর সুন্দর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু মানসম্মত প্রকল্প বাস্তবায়ন এই ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় বিনোদন ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা থাকলে পর্যটনশিল্প প্রসার লাভ করবে। আর বিদেশিদের জন্য দরকার নিরাপদ সড়ক, সুন্দর থাকা-খাওয়ার হোটেল-মোটেল এবং পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বাংলাদেশের পর্যটনের টেকসই বিকাশ এবং উন্নয়নে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ পর্যটনের বিকাশে গতি আনতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের পর্যটনশিল্পের প্রচার ও উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি টু্যর অপারেটর, হোটেল ও এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশ সবুজ, সবুজরাঙা এই দেশে সবুজের সঙ্গে বিনোদন যোগ করতে পারলে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে। তাই সরকারের উচিত, পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারসহ সারা দেশে কিছু কিছু অংশে উন্নয়ন ঘটাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে