সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনপরবর্তী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ডলারের সংকট নিরসন ও দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা নতুন সরকারের আরও একটি বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়া গত বছর ব্যাপক প্রভাবিত করেছে দেশের অর্থনৈতিক খাতকে।
মো. সফিউল আলম প্রধান
  ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

নির্বাচনপরবর্তী সময়ে সরকারের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জকে দু'টি ভাগে বিভক্ত করা যায়। এক, অভ্যন্তরীণ ও দুই. আন্তর্জাতিক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনপরবর্তী সময়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতা ও রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া নির্বাচনকে ঘিরে দলের মধ্যে যে কোন্দল ও গ্রম্নপিং চলছে, বিশেষ করে স্বতন্ত্র ও দলীয় প্রার্থীর মধ্যে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সেটিকেও সমাধান করে দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি যে পুরোপুরি ইতিবাচক নয়, তা তাদের বেশ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছুদিন ধরেই চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধা দিতে চাওয়া ব্যক্তিদের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আনার ঘোষণাও দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বেশ কয়েকবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আমাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন। তার মতে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করাটাই নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এর অন্যতম কারণ, আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার ইউরোপ এবং আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের পর নির্বাচন প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপীয় কমিশনের দুই সাংসদ কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়ে আহ্বান জানান, যেন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ইউরোপও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়।

এসব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নতুন সরকারকে মোকাবিলা করতে বেশ কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিবিদদের মতে ২০২৪ সালের সরকারের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। বিবিএসের হিসেব অনুযায়ী ২০২২ সালে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৬ শতাংশ ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৭ শতাংশে। জুলাই-আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ শতাংশের ওপর। যার প্রভাব ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এটি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সাধারণ ও নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করা মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে সরকার মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সমন্বয়ের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে, যাতে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে।

ডলারের সংকট নিরসন ও দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা নতুন সরকারের আরও একটি বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়া গত বছর ব্যাপক প্রভাবিত করেছে দেশের অর্থনৈতিক খাতকে।

\হকেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের পহেলা জুন থেকে এখনো পর্যন্ত গত দেড় বছরে টাকার তুলনায় ডলারের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে- যার প্রভাবে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বেশি দামে পণ্য আমদানি করায় সাধারণ মানুষকে ক্রয় করতে হয়েছে বেশি টাকার বিনিময়ে। অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান সুদের হারের মতো বিনিময় হারও একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থার মধ্যে আনার ওপর জোর দিয়েছেন। যাতে আগামীতে বিনিময় হারে অস্থিরতা কমে আসে। সরকারকে এক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা নতুন সরকারের জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত এক বছর বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে গত জানুয়ারিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২.২২ বিলিয়ন ডলার- যা ডিসেম্বরে এসে পৌঁছেছে ২১ বিলিয়ন ডলারে। যদিও গত এক সপ্তাহ আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণসহ অন্যান্য উৎস থেকে ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত অর্থ, আইএমএফ'এর এসডিআর খাতে থাকা অর্থ, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসেবে থাকা অর্থ এবং আকুর বিল পরিশোধ বাবদ অর্থ হিসেবে নিলে রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমবে বলে বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এমন পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হতে পারে রপ্তানি আয় পুরোপুরি দেশে ফিরে না আসা- যা ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং (কোনো পণ্যের আসল দামের চেয়ে বেশি দাম দেখানো), ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে অনেক টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ নজরদারির দায়িত্বে থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানকে আরও কঠোর হতে হবে। নির্বাচনপরবর্তী সময়ে দেশ কোন দিকে যাবে তা নিয়ে আশা আর প্রত্যাশার সঙ্গে সারাদেশের মানুষ শঙ্কা আর সম্ভাবনার দোলাচলে রয়েছেন। রাজনীতি আর অর্থনীতির গতি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে স্বস্তি ফিরবে নাকি সংঘাত-সংকটে আরও জর্জরিত হবে তা এখনই কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না। তবে আমরা নতুন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।

মো. সফিউল আলম প্রধান : শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে