বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কতটা সম্ভব

বাজারের নৈরাজ্য আর মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে শ্রমজীবী, স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালিতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। বাজারে পর্যাপ্ত পণ্যের সরবরাহ আছে। তা সত্ত্বেও পণ্যের দাম বাড়ছে। মূলত এটা বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা। যে করেই হোক, নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ভেতর আনতে হবে। পূরণ করতে হবে সিন্ডিকেট ভাঙার অঙ্গীকার।
সালাম সালেহ উদদীন
  ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কতটা সম্ভব

দীর্ঘদিন থেকেই উচ্চমূল্যের কবলে পড়েছে দেশের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অস্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। নিত্যপণ্যের বাজার কোনোভাবেই স্থির হচ্ছে না। একেক সময় একেক অজুহাত তুলে বিক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ দেশের অতিমুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় কোনোরকম বিবেক বিবেচনা ছাড়াই। ঊর্ধ্বগতির বাজারে নতুন করে চালের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে সরকারের তদারকির অভাব ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন তারা। এটা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং বাজার সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী বাজে দিক। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের অজুহাতের শেষ নেই। তারা একেক সময় একেক অজুহাত দাঁড় করায়। তারা খাদ্যে ভেজালও দেয়। তাদের কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত জিম্মি হতে পারে এটা তারা কখনোই ভাবে না। তারা অর্থলোভী। অর্থ উপার্জনই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ কষ্টে আছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ে কাজ করছি। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছি। তারপরও কিছু মানুষ চক্রান্ত করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়াচ্ছে। সোমবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের যৌথসভায় তিনি এসব কথা বলেন। এ ছাড়াও বাজারে পণ্যের দাম নিয়ে যারা কারসাজি করে তাদের নজরে রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গঠিত নতুন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। পণ্যের দাম কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে দ্রম্নত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি নেওয়া হলে '৩৩৩' নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানানো যাবে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এই সুবিধা চালু করা হবে। সচিবালয়ে সোমবার বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ। সেখানেই তিনি এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব ভালো উদ্যোগ। তবে ব্যবসায়ীরা জনগণের স্বার্থের দিকে কখনোই নজর দেয় না। এরা বাজারসন্ত্রাসী। কীভাবে অসৎ উপায় অবলম্বন করে দ্রম্নত ধনী হওয়া যায় সেটাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বাজারে মূল্যতালিকা টাঙিয়ে যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের অসহায় জনগণকে জিম্মি করে তারা বারবার পকেট কাটবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর আগে তারা চাল, ডিম, চিনি ও পেঁয়াজের বাজারে সৃষ্টি করেছিল অস্থিরতা। অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল ভোজ্যতেলের বাজারেও। এবার তারা আদা, রসুন, আলু ও পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। খুচরা বাজারে এখনো পেঁয়াজ ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আদা ৩০০ টাকা, রসুন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, ভরা মৌসুমেও আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে। মাছ-মাংসের কথা তো বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের পরই গুরুর মাংসের কেজি হয়েছে ৭০০ টাকা। ২০০ টাকা কেজির নিচে কোনো মাছ নেই। এর আগে অসৎ ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ডিম, ভোজ্যতেল ও মুরগির দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে, কিছুদিন আগে ভারত পেঁয়াজের আমদানি বন্ধের ঘোষণায়। এ দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে আর আগের অবস্থানে ফিরে যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অনেক পণ্যের দামই কম, অথচ দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বা গা ছাড়া ভাব লক্ষণীয়।

দেশের মানুষের আয় যেভাবে বাড়ছে, তার তুলনায় ব্যয় বাড়ছে তীব্র গতিতে। নিম্নবিত্তের মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পেলেও বাড়তি ব্যয়ের চাপে পিষ্ট মধ্যবিত্তরা। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। তারা এখন টিসিবির খাদ্যপণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। শাকসবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর আগে করোনাকালে দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। করোনার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। যদিও এবারের নির্বাচনী অঙ্গীকারে এটা রয়েছে। নতুন দরিদ্র মানুষের পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে না। দরিদ্র মানুষ টিকে থাকার চেষ্টা করছে। করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত সময়ে গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমা-বাড়া, খাদ্যপণ্যের দামের ওঠানামা, কর্মসংস্থান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষের প্রচেষ্টা, পেশার পরিবর্তনসহ নানা বিষয় আলোচনায় এসেছে।

এখন আবার অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে নতুন করে উচ্চমূল্যের কবলে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্যও তারা কিনতে পারছে না। তাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশে ২০২১ সালের শুরু থেকেই মূল্যস্ফীতি মাথা তুলতে শুরু করে। আর এখন বিশ্বের অন্তত ৫৮ শতাংশ উন্নত ও উদীয়মান দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের উপরে। আর বিশ্বের অন্তত ৭০ শতাংশ দেশে এখন মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রার মানে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। অর্থনৈতিক কৌশলগত কারণের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও মূল্যস্ফীতির এমন অবস্থা। দেশে গড় হিসেবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমছে না। অর্থাৎ বাজারে এর প্রভাব নেই।

বাজারের নৈরাজ্য আর মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে শ্রমজীবী, স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালিতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। বাজারে পর্যাপ্ত পণ্যের সরবরাহ আছে। তা সত্ত্বেও পণ্যের দাম বাড়ছে। মূলত এটা বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা। যে করেই হোক, নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ভেতর আনতে হবে। পূরণ করতে হবে সিন্ডিকেট ভাঙার অঙ্গীকার।

গরিব ও মধ্যবিত্তের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাদের ইচ্ছে পূরণের জায়গাগুলো ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। তাদের মৌলিক চাহিদা ও স্বপ্ন প্রতিনিয়ত মাঠে মারা যাচ্ছে। তারা হয়ে পড়ছে হতাশাগ্রস্ত দিশেহারা। ছোট হয়ে যাচ্ছে তাদের মনও। কেবল অর্থনৈতিক কারণে অনেক পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। শারীরিক নির্যাতন, হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। কারণ বাজারে সবকিছুর দামই এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য এক ধরনের সতর্কবার্তা। একটি উন্নয়নকামী দেশের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। মূল্যস্ফীতি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে এটা হবে এক অশুভ সংকেত। কোনোভাবেই বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হলে চলবে না। নতুন সরকারকে তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারও। এই অঙ্গীকার পূরণ করতে কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে