রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা জরুরি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী। এ নদীসমূহের পানি ভাগাভাগি নিয়ে চলে অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনীতি। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। ফারাক্কা বাঁধ নিয়েও রয়েছে দ্বন্দ্ব। বিশ্বের ২৭৬টি সীমান্ত অতিক্রমী নদী অববাহিকার পানি বিশ্ব জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের প্রাথমিক পানির উৎস। বিশ্বে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতাময় পরিবেশ থাকা জরুরি।
অমল বড়ুয়া
  ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা জরুরি

প্রাণ সৃষ্টির চার উপাদানের মধ্যে পানি অন্যতম। পানি জীবনের অবিচ্ছেদ্য ও অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পৃথিবীর সব ধরনের প্রাণী, গাছপালা-তরুলতা সবাই পানির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ৭১ শতাংশ পানির তুলনায় শুষ্কভূমি মাত্র ২৯ শতাংশ। পৃথিবীর মোট জলভাগের প্রায় ৯৭ দশমিক ৩ শতাংশ হচ্ছে নোনাপানি আর বাকি ২ দশমিক ৭ শতাংশ হচ্ছে স্বাদুপানি। বিশ্বে স্বাদুপানির প্রায় ৬৯ শতাংশ রয়েছে ভূগর্ভে আর ৩০ শতাংশ মেরু অঞ্চলে বরফের স্তূপ হিসেবে জমা আছে এবং মাত্র ১ শতাংশ আছে নদী ও অন্যান্য উৎসস্থলে। জীবজগতের জীবনধারণে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের দেহের দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে পানি। জীবদেহ গঠনের একক 'কোষ'-এর প্রোটোপস্নাজমের ৯০ শতাংশ পানি দিয়ে তৈরি। যদি কোনো কারণে দেহে পানির অভাব হয়, তাহলে এই প্রোটোপস্নাজমগুলো কুঁচকে যায় এবং নষ্ট হয়ে যায়। পানি বলতে বিশুদ্ধ নিরাপদ পানির কথাই বলা হচ্ছে। আর পর্যাপ্ত ও নিরাপদ খাবার পানি মানবাধিকার ধারণার পূর্বশর্ত। তবে পুরোপুরি নিরাপদ পানি পানের সুযোগ এখনো সীমিত- যার পরিমাণ ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। সারা পৃথিবীতে পানির খুব অভাব। ২৮টি দেশে এই অভাবের অবস্থা খুবই গুরুতর। ৩০ বছর পর পানির অভাবে দুর্গত লোকের সংখ্যা হবে দুই থেকে তিনশ' কোটি। প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৩১ লাখ মানুষ দূষিত পানি পান করার ফলে নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। দুঃখের বিষয়, এদের প্রায় ৯০ শতাংশই ৫ বছরেরও কম বয়সের শিশু। বিশ্বে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন করে শিশু পানিবাহিত রোগে মারা যায়। পানিবাহিত রোগে প্রতি বছর পৃথিবীতে মৃতু্য হচ্ছে ৮ লাখ ৪২ হাজার লোকের অর্থাৎ প্রতিদিন ২ হাজার ৩০০ জন লোকের। বিশ্বের ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা দুই কোটি ৬০ লাখ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করা। এ জন্য খরচ করতে হবে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার।

প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে নদীকে ঘিরে। পানির আধার নদীকে কেন্দ্র করে গোড়াপত্তন হয়েছে পৃথিবীতে নগরসভ্যতার। লন্ডনের টেমস নদী থেকে ঢাকার বুড়িগঙ্গা কিংবা চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর খরস্র্রোতা তীরে গড়ে উঠেছে নগরব্যবস্থা ও ব্যবসাবাণিজ্য কেন্দ্র। বিশ্ব অর্থনীতিতে পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের খাদ্য উৎপাদনে-কৃষিকাজে পানির প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাংলাদেশে পানির ব্যবহারের ৮৮ শতাংশ চাষাবাদের কাজে, ১০ শতাংশ গৃহস্থালির কাজে এবং বাকি মাত্র ২ শতাংশ শিল্পখাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশুদ্ধ পানির প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় সেচকাজে। পরিসংখ্যানমতে, পৃথিবীতে মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক জনশক্তিই পানিসংক্রান্ত এবং পানিকে ঘিরে জীবিকানির্বাহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সারাবিশ্বে যার সংখ্যা প্রায় দেড় বিলিয়ন। বঙ্গোপসাগরের নীল-অর্থনীতি খুলে দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার দুয়ার। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন (২০১৮) অনুযায়ী আমাদের সমুদ্র দেশের অর্থনীতিতে মোট মূল্যসংযোজনে ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বা জিডিপিতে ৩ শতাংশ অবদান রাখছে। এ অর্থনীতি মূলত পর্যটন ও বিনোদন (২৫ শতাংশ), মৎস্য আহরণ ও অ্যাকুয়াকালচার (২২ শতাংশ), পরিবহণ (২২ শতাংশ) এবং তেল ও গ্যাস উত্তোলন (১৯ শতাংশ) নিয়ে গঠিত। মৎস্য আহরণ ও অ্যাকুয়াকালচারে পূর্ণ ও খন্ডকালীন মিলিয়ে ১৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। অন্যদিকে, লবণ উৎপাদন ও জাহাজভাঙাশিল্পে নিয়োজিত আছে প্রায় ৬০ লাখ লোক। বাংলাদেশের ৮২ ভাগ বৈদেশিক বাণিজ্য সমুদ্রবাহিত। 'সেভ আওয়ার সি'র তথ্যমতে, প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারেন মাত্র ৭ লাখ টন। বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানির ৯৫ শতাংশই হয় বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বসবাস সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে এবং প্রায় তিন কোটি মানুষ মৎস্য আহরণ ও পরিবহণের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে পৃথিবীর ১৬ শতাংশ বিদু্যৎ উৎপন্ন হয় পানি প্রকল্প থেকে। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ শক্তি উৎপন্ন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে- যা পানি ছাড়া সম্ভব নয়।

পানিসংকট একটি বৈশ্বিক সংকট। পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রম্নত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, পানিদূষণ ও অপচয় হলো পানিসংকটের অন্যতম কারণ। ২০৩৫ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সালে চরম পানিসংকটে পড়বে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেলের গবেষণামতে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২০ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রবল ঘাটতি আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দেশে পানির স্বল্পতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদ বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে এবং এর কারণে নিরাপদ সুপেয় পানিপ্রাপ্তি হবে আগামী বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ। আন্তঃসীমান্ত পানিসম্পদ ব্যবহার নিয়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সহযোগিতার পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ ও অধ্যয়ন বিষয়টিকে 'পানি-রাজনীতি' ('ওয়াটার পলিটিকস') কিংবা 'হাইড্রো পলিটিকস' নামেও অভিহিত করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের মতে, ২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পানি নিয়ে সংঘাত হয়েছে কয়েকশ' বার। পানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাচীনকাল থেকে। ইতিহাসমতে, পশ্চিম এশিয়ার দেশ প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় খ্রিষ্টপূর্ব ২৫ শতকেই পানি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। 'ওয়াটার কনফ্লিক্টস ক্রোনলজি' নামে একটি রিপোর্ট পানিকে কেন্দ্র করে এবং পানির ব্যবহারের মাধ্যমে উলেস্নখযোগ্য ১ হাজার ২৯৮টি বিরোধ ও সংঘাত সংঘটিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে। ইতিহাস বলছে, শত্রম্নপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে লাগাসের রাজা উরলামা খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৫০ থেকে ২৪০০ অব্দ পর্যন্ত পানির ধারার গতি পরিবর্তনের মাধ্যমে শুষ্ক অঞ্চলকে পানিবঞ্চিত করে আরও শুষ্ক অঞ্চলে পরিণত করতে থাকেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭২০ থেকে ১৬৮৪ অব্দ সময়ে বিখ্যাত টাইগ্রিস নদীতে বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। প্রচলিত আছে হামুরাবির দৌহিত্র আবিশ ব্যাবিলনের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বিদ্রোহীদের দমনের জন্য টাইগ্রিস নদীতে বাঁধ নির্মাণ করেন। ৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদি বিক্ষোভকারীরা পানির ধারা পরিবর্তনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রোমান সৈন্যদের হাতে নিহত হয়।

১৬৭২ সালে চতুর্দশ লুই তৃতীয় ডাচ যুদ্ধে প্রতিরক্ষার খাতিরে তাদের বাঁধগুলো খুলে দেয় এবং দেশটিকে পস্নাবিত করে এমন একটি জলীয় বাধা তৈরি করে- যা কার্যত ফরাসিদের জন্য দুর্ভেদ্য হয়ে পড়ে। ১৯৭৪ সালে ইরাক সিরিয়ার বাঁধ বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দেয়। ১৯৭৬ সালে চীনের ঝাং নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ এবং অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের কারণে ওই অঞ্চলে সংঘর্ষ বাধে। ১৯৭৬ সালে পানির দূষণ ঘটিয়ে মোজাম্বিকের ক্ষতি করার চেষ্টা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। মিসরের নীলনদ প্রায় ১২টি দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নীলনদের জলবণ্টন নিয়ে 'কো-অপারেটিভ ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন দ্য নীল রিভার বেসিন' নামক একটি চুক্তি স্বাক্ষর হলেও বুরুন্ডি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, মিসর, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডাসহ আরও কয়েকটি দেশ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। কানাডার সাস্কাচেওয়ান প্রদেশে ৮২ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা সুপেয় জলধারা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে পানি দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় দুই দেশের মধ্যে টানাপড়েন ও দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। সিন্ধু অববাহিকাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো আন্তর্জাতিক জল ভাগাভাগির 'ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি' চুক্তিটি ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সিন্ধু পানিচুক্তি অনুসারে এই অববাহিকার পূর্বদিকের তিনটি নদী- বিয়াস, রাভি ও শতদ্রম্নর জল ভারতকে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং পশ্চিমের তিনটি নদী- চন্দ্রভাগা, সিন্ধু ও ঝিলমের ভাগ পেয়েছে পাকিস্তান। এসব নদীতে কিষেণগঙ্গা ও রাতলের মতো প্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সিন্ধু চুক্তিকেই লঙ্ঘন করছে বলে পাকিস্তানের অভিযোগ।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী। এ নদীসমূহের পানি ভাগাভাগি নিয়ে চলে অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনীতি। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। ফারাক্কা বাঁধ নিয়েও রয়েছে দ্বন্দ্ব। বিশ্বের ২৭৬টি সীমান্ত অতিক্রমী নদী অববাহিকার পানি বিশ্ব জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের প্রাথমিক পানির উৎস। বিশ্বে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতাময় পরিবেশ থাকা জরুরি।

অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে