সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা ও মানবিক বিপর্যয়

মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। সত্য এই যে, বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের মতো এত নির্যাতিত, হত্যার নিষ্ঠুর শিকার আর কোনো জাতি আছে কিনা তা বিশ্ববাসী ভালোই জানে।
মোহাম্মদ শামসুল কবির
  ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা ও মানবিক বিপর্যয়

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলের অত্যাধুনিক এবং চৌকস বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরাইলে ঢুকে পড়ে তাদের হামলায় ২৯৯ জন সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ মোট ১৪০০ জন নিহত হন। এর ফলে ইসরাইল গাজার ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার জায়গায় এ পর্যন্ত ২৬ হাজার প্রাণ নিয়েছে, যাদের মধ্যে নারী, শিশু, বয়োবৃদ্ধসহ সাধারণ নাগরিকরা রয়েছে। গাজা শহরটি এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। চলছে প্রতিনিয়ত হামলা, স্থলপথ, আকাশপথ দিয়ে আক্রমণ। এরপর রয়েছে পশ্চিমাদের ট্যাঙ্কসহ বিভিন্ন গোলাবারুদ। প্রায় চার মাস এখনো সেখানে শিশু ও নারীদের কান্না থামছে না। থামছে না ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বর হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বহু দেশ যুদ্ধ বন্ধের কথা বললেও নেতানিয়াহুর মাথায় গাজায় হত্যা ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নেই। দেখে মনে হয়, এ যুগের সবচেয়ে বড় ফেরাউন ছাড়া আর কিছুই নয়। আলস্নাহ বলেছেন, যারা ইমান এনেছে, মোমিন, মুত্তাকিন ও পরহেজগার তাদের সঙ্গে আমি নিজেই আছি। পুরো গাজায় স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হসপিটালসহ বাড়িঘর ও অফিস-আদালত সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। মূলত গাজা এখন বিরানভূমি ছাড়া আর কিছুই নেই। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসলাইলি সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে মূল ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করছে পশ্চিমারা। এরদোয়ান অভিযোগ করেন, ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের মৃতু্যর জন্য পশ্চিমা দেশগুলো চোখের জল ফেলে, কিন্তু গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মৃতু্যতে তারা চোখ বন্ধ করে রয়েছে।

বলাবাহুল্য, ইসলাইল যখন ১৯৪৮ সালে জার্মানি, ফান্স, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনি বিরোধী মিছিল সমাবেশ ও প্রচার করা হয়েছিল। এবারও ইসরাইল দখলদার বসতি স্থাপনকারীদের সমর্থনে তা শুরু করেছে। জার্মানরা ইসরাইলের কর্তৃত্ববাদী ইহুদি নেতাদের উদ্দেশে স্স্নোগান দিচ্ছে, বার্লিন তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যেও সেই স্স্নোগানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এখন একজোট হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা। এরা সবাই প্রচন্ড বর্ণবাদী, ইসরাইল যেহেতু একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র সেহেতু তারাই সঙ্গে থাকবে এটিই স্বাভাবিক। পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ বলেছেন, ইহুদি ও খ্রিষ্টান তা এপিঠ ওপিঠ। এদের সঙ্গে সব সময় পশ্চিমারা সমতালে কাজ করে। আর ধ্বংস ও চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু, নেই। এককথায় নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। দীর্ঘ ৭৫ বছর হলো ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতার জন্য নিজেদের ভূমিতে লড়াই করে যাচ্ছে। হাজার হাজার মৃতু্য দেখছে, বাড়িঘরসহ সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল, আর সারা বিশ্ব চেয়ে চেয়ে দেখছে। এদের ঘৃণা করা ছাড়া আর কি করার আছে। অথচ আরব নেতারা ওআইসির মতো সংগঠন এ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, মিশর, জর্ডান, ইয়েমেন সবতো ধ্বংস করে দিয়েছে। মুসলমানরা আজ ঐক্যবদ্ধ না থাকায় এটিই হচ্ছে বড় কারণ।

মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। সত্য এই যে, বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের মতো এত নির্যাতিত, হত্যার নিষ্ঠুর শিকার আর কোনো জাতি আছে কিনা তা বিশ্ববাসী ভালোই জানে।

এটি আমরা সবাই জানি, নিরস্ত্র মানুষকে মারা বা হত্যা করা কতখানি অপরাধ, তারপরও পশ্চিমাসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় মুসলমানদের ওপর হিংসাবিদ্বেষ, নির্যাতন, বর্ণবাদী আরও বেড়েই চলছে। এটা ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলি দুই নারীকে মুক্তি দিয়েছে। কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় দুই বন্দিকে মুক্তি প্রদান করেন। তারা হলেন- নূরিত কুপার (৭৯) ও ইয়েঅমেভেদ লিডমৎজ (৮৫)। এই প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) ছিলেন। মুক্তির পর তারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে জানিয়ে দেন হিব্র ভাষায়... মাধ্যমে আমি নরকে গিয়েছিলাম, তবে অপহৃত অবস্থায় হামাস আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে। তেলআবিবে একটি হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলনে... নিজে এসব কথা বলেন। এটিই চরম সত্য, এর একটি মুসলিম শান্তি ও মানবতার ধর্ম, এর চেয়ে আর কি প্রমাণ হতে পারে। ইচ্ছা করলে হামাস তাদের হত্যা করতে পারত, খারাপ ব্যবহার করতে পারত, কিন্তু না তা তারা কিছুই করেনি। এরই নাম ইসলাম।

১৯৩০-এর দশক থেকে ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারল তারা তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে এবং ১৯৪৮ সালে ইসরাইলে বসতি স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ, ব্রিটেনের মাধ্যমে ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, পিএলওকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনির কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গাজা শাসনের বিষয়টি উলেস্নখ ছিল। কিন্তু বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ও বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের কথা ইসরাইল একদম কানেই নিচ্ছে না। তারা আরও বেশি গাজায় হামলায় তৎপর হয়ে উঠছে। কীভাবে গাজাকে দখল করে নেওয়া যায় এবং গাজাকে উচ্ছেদ করা যায়।

ইসরাইল স্বপ্ন দেখছে এবং রূপরেখা তৈরি করছে ইসরাইলের নেতানিয়াহু সরকার কীভাবে গাজাকে শাসন করবে সেই চিন্তা করছে।

এদিকে গণহত্যা ঠেকানোর জন্য জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) আন্তর্জাতিক বিচার আদালত মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। জেনোসাইডের অভিযোগে এই মামলা এর পূর্বে রোহিঙ্গা, ... জাতিহত্যার মামলা করেন। সে মামলা এখনো চলছে। গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার অভিযোগ এনে গত ২৯ ডিসেম্বরে আইসিজেতে মামলাটি এ মাসের ১১ ও ১২ তারিখে শুনানি হয়। শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার... গাজায় যুদ্ধ বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে আদালতের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যদিকে, ইসরাইলের পক্ষ থেকে গণহত্যার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ইসরাইলের হামলায় এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ২৬ হাজার নিরীহ শিশু, নারী ও সাধারণ নাগরিকের মৃতু্য হয়। আইসিজের ১৭ জন বিচারকের সঙ্গে ১৫ বিচারক আদালতের এই আদেশের পক্ষে ভোট দেন। আদেশে গাজায় যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ না দেওয়া হলে ও গণহত্যার মামলাটি চলমান থাকবে বলে জানিয়েছেন আইসিজে। আদেশে বলা হয়েছে, ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী ফিলিস্তিনির গণহত্যা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী জনগোষ্ঠী। এ রায়ে ইসরাইল সন্তুষ্ট নন। যুক্তরাষ্ট্র অনুরূপ ইইউ এক বিবৃতি জানিয়েছেন তারা অবিলম্বে আইসিজের আদেশের কার্যকর বাস্তবায়ন চান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডবিস্নউ) এন্ড বার্জার আইসিজের আদেশকে সাফল্য হিসেবে উলেস্নখ করেছেন। এদিকে আইসিজের আদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন সৌদি আরব ও কাতার। উলেস্নখ্য, ফিলিস্তিনিদের পাশে বাংলাদেশ সব সময় রয়েছে এবং থাকবে- ইনশাআলস্নাহ।

ফিলিস্তিনিতে অজস্র পবিত্র ভূমি নবী ও রাসূলদের সমাধিস্থান এবং তাৎপর্যপূর্ণ এলাকা। সারা বিশ্ব এখন চেয়ে চেয়ে দেখবে নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ কীভাবে দেখে। যেদিন ফিলিস্তিনিরা একদিন ঠিকই তাদের মুখে হাসি ফুটবে এবং সেখানে শান্তি ফিরে আসবে এবং ১৯ লাখ উদ্বাস্তু পুনরায় ফিরে আসবে ফিলিস্তিনিতে ইনশাআলস্নাহ।

মোহাম্মদ শামসুল কবির : লেখক ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে