মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মহত্যা রোধে করণীয়

মো. মোকাদ্দেস আলী শিক্ষার্থী এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আত্মহত্যা রোধে করণীয়

২৭ জানুয়ারি সংবাদ মাধ্যমেগুলোতে ২০২৩ সালের আত্মহত্যা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেওয়া হয়েছে আত্মাহত্যা প্রতিরোধে ১০টি পরামর্শ। কিন্তু গোড়া চিহ্নিত করতে পারলেন না। পরামর্শ হতে হবে গবেষণা নির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ। যে পরামর্শ সমস্যার উৎপত্তি স্থল বিনাশ করতে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।

প্রতিবেদনে বক্তারা বলেছেন ভুক্তভোগীদের কথা বলার জায়গা নেই। ফলে আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই কথাটি সবাইকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেতে হবে। কথা বলার জায়গা নেই বলতে বোঝানো হয়েছে ভুক্তভোগী তার সমস্যাগুলো বলার জন্য বিশ্বস্ত কোনো মানুষ পায় না, যাকে মন খুলে সব বলা যাবে এবং শোনার পরে তাকে কোন প্রকার বিদ্রম্নপ না করে তার পাশে থাকবে। সমস্যা বলার পর সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য সাপোর্ট দরকার। সমস্যা বলার মাধ্যমে যেমন হালকা হতে পারবে তেমনি সমাধানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। কীভাবে সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে, কৌশলগুলো কি কি হবে, কীভাবে বাস্তবায়ন করবে?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মতামত দিলেন পাঠ্যপুস্তকে আবেগ নিয়ন্ত্রণের ধারণা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। খুব সুন্দর একটি প্রস্তাবনা। খুব দ্রম্নততম সময়ে পাঠ্যপুস্তকে আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আবেগ নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ যা শিক্ষকের থেকে সাইকোলজিস্টরা ভালোভাবে ম্যানেজ করতে পারবেন। তবে শিক্ষকরা একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে শিক্ষকরা যে মেয়ে শিক্ষার্থীর দুর্বলতার সুযোগ নেবে না, তা কি করে নিশ্চিত হবেন? পত্র-পত্রিকাতে আমরা শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ বা অবৈধ সম্পর্কের নিউজ দেখতে পাই।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে দরকার মনিটরিং ও সংকট মুহূর্তে প্রয়োজনীয় আবেগীয় সাপোর্ট। আমরা যদি গোড়া শক্ত না করে শাখা প্রশাখা শক্ত করি তাহলে কি তা আদৌ কোনো সফলতা আসবে? যদি গোড়া শক্ত করা যায় তাহলেই পাওয়া যাবে সত্যিকারের সফলতা। ২০২৩ সালে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে- যার মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ২২৭ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ১৪০ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯৮ জন ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ৪৮ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আত্মহত্যার ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীদের বয়স ১৩ থেকে ১৯। আত্মাহত্যা রোধে সবার আগে দরকার একজন মনের বন্ধু। এক্ষেত্রে বাবা-মা হতে পারে সব থেকে বেশি নিরাপদ। অর্থাৎ মনের প্রধান বন্ধু হলো বাবা-মা। মনের বন্ধু অনেকেই থাকতে পারে তবে সেখানে ক্ষতির আশঙ্কাও থাকতে পারে। সবচেয়ে নিরাপদ মনের বন্ধু বলতে গেলে পরিবারের নামটা সবার আগে। বাবা-মা চাইলেই তার সন্তানের মনের বন্ধু হতে পারে। সন্তান অল্প বয়সে ভুল করবে স্বাভাবিক। এ সময় তারা অপরিপক্ব থাকে। ছেলেমেয়েরা তাদের নিজস্ব জেন্ডার সম্পর্কে অবগত হয়। তাদের মধ্যে নতুন এক আবেগ কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তন আসে। এ বয়সে তারা দুরন্ত। যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এক সেকেন্ডও ভাবে না। এ সময় তারা অনেক ভুলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পিতা-মাতার ভয়ে তাদের সঙ্গে ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চান না। নিজের মধ্যে সবকিছু চাপা রাখেন। সমস্যাগুলো সহপাঠীদের কাছেও প্রকাশ করতে চায় না। প্রকাশ করলেও যথার্থ সাপোর্ট পায় না। যদিও সহপাঠীদের সাপোর্ট পায় তা কতটুকু বাস্তবসম্মত সেটার একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। পরিবারকে সব সময় সন্তানের পাশে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাশে থাকা মানে এই নয় যে তাকে কঠোরতার মধ্যে রাখতে হবে, তার স্বাধীনতাকে বাধা দিতে হবে। তার বয়স উপযোগী কাজগুলো তাকে করতে দিতে হবে। শুধু একটু খেয়াল রাখতে হবে সব ঠিকঠাক করছে কি-না। সন্তানকে ওপেন স্পেস দেওয়া যেন তার প্রতিটি সমস্যা পিতা-মাতাকে নির্ভয়ে বন্ধুর মতো বলতে পারে। সন্তান তার পিতা-মাতার সঙ্গে যে ভুল নিয়ে আলোচনা করে সেটা শোনার পর সমালোচনা না করে তাকে আগে মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। সন্তানকে বোঝানো আমরা তোমার পাশে আছি। আমরা তোমাকে সাহায্য করব, তোমার কোনো ভয় নেই। সন্তান স্বাভাবিক হলে সেই বিষয় নিয়ে পিতা-মাতা আলোচনা করবে। সন্তানের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পিতা-মাতা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সন্তান তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে।

আত্মাহত্যার ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। মেয়েরা চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর বাসাতেই তাদের দিন কেটে যায়। তাই জীবনে কোনো খারাপ পরিস্থিতির শিকার হলে সেটা ভ্যান্টিলেট করার সুযোগ কম পায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলেরা স্বাধীন। নিজের মতো করে পছন্দের জায়গা বেড়াতে পারে। বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারে।

মেয়েদের আত্মহত্যার একটি কারণ হলো তার পছন্দের জায়গাগুলোতে বেড়ানোর অনুমতি না দেওয়া। ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪৯ যা সর্বোচ্চ। ঢাকা যান্ত্রিক শহর। এখানে পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া কম বললেই চলে। যে যার মতো ব্যস্ত। টাকার চাহিদা মেটানো মুখ্য। সন্তান কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার কোনো খোঁজখবর নেই। পিতা-মাতা নিজ উদ্যোগে সন্তানের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি পিতা-মাতার প্যারেন্টিং স্টাইল ও এটাস্টমেন্ট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো বুলিং। পরিবার ও শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা বুলিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রতিবেশীরাও পিছিয়ে নেই। আত্মহত্যা প্রতিরোধে শিক্ষকদের মানসিকভাবে উন্নতি করা যেতে পারে। তারা যেন শিক্ষার্থীদের বুলিং না করে। একজনের সঙ্গে অন্যজনের তুলনা না করে। ছোট করে বা লজ্জা দিয়ে কথা না বলে। সবাই আলাদা, সবাই সমান মেধাবী হবে না এটা শিক্ষকদের বিশ্বাস করতে হবে। পিতা-মাতাকে ভাবতে হবে আমরা যখন পড়াশোনা করেছি তখন যেমন সবাই সমান মেধাবী ছিলাম না তাই এখনো সবাই সমান মেধাবী হবে না। পাশের বাড়ির ছেলে বা মেয়েছি যেমন রেজাল্ট করবে আমার ছেলে বা মেয়ে একই রেজাল্ট করবে সেই প্রত্যাশা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে পিতা-মাতা তার সন্তানের দুর্বল জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করতে পারেন, আলোচনা করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে পাশের বাড়ির কেউ ভালো রেজাল্ট করলে নিজের সন্তানের প্রতি শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। পিতা-মাতাকে মানতে হবে আলস্নাহ সবাইকে সমানভাবে সৃষ্টি করেননি। তিনি ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। সুতরাং অন্যের সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা না করে সন্তানের বাধা-বিপত্তিগুলো নিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন। হতেও পারে আপনার ছেলেমেয়ে অন্যদের তুলনায় সুন্দর গান করতে পারে, আইটি সেক্টরে ভালো, ভালো খেলোয়াড়।

টপিক টা যখন সমালোচনা তখন প্রতিবেশী সেরা। কোন ছেলে বা মেয়ে যদি অল্প বয়সে কোন সমাজবহির্ভূত কাজ করে তাহলে প্রতিবেশী ছি! ছি! করা শুরু করে। তারা মানতে চায় না এটা তাদের ভুলের বয়স, তাদের আবেগ এই সময় বেশি কাজ করে। কথায় কথায় রাস্তাঘাটে প্রতিবেশী বুলিং করতে শুরু করে। এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে তাদের কাছে মনে হয় আত্মহত্যা উত্তম পথ। পিতা-মাতাকে বুঝতে হবে প্রতিবেশীর কথা শুনে নিজের সন্তানকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা যাবে না।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় 'সমগ্রতাবাদ' নামে একটি থিওরি আছে। যেখানে বলা হয়েছে সব কিছু সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হবে। একটি মানুষের অনেকগুলো দিক আছে। একটি দিক বিবেচনা করে মন্তব্য করা যাবে না। হতে পারে ছেলেটি বা মেযেটি আবেগের বশে ভুল করেছে। কিন্তু অন্যান্য দিক ভালো। যেমন পড়াশোনায় ভালো, মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে, মানুষকে সাহায্য করে, বিপদে এগিয়ে আসে, সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, খুবই পরিশ্রমী।

একটি মানুষের সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হবে। আত্মহত্যার অন্যতম একটি কারণ হলো বিচ্ছিন্নতা। ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ও টিভি সিরিয়ালগুলো সন্তান ও পিতা-মাতাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

মনের আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হলো সাইকোলজিস্ট। আত্মাহত্যা না করলেও অনেক শিক্ষার্থীর মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা মানসিক সমস্যার কারণে একাডেমি পারফরম্যান্স আশানুরূপ করতে পারছেন না। সাইকোলজিস্টের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে অনেক আগে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিস্ট নিয়োগের সুপারিশ করা হয় কিন্তু এখন পর্যন্ত আশার মুখ দেখেনি। একজন সাইকোলজিস্ট সব তথ্যকে গোপন রেখে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মনোবৈজ্ঞানিক কৌশলগুলো ব্যবহার করে আবেগীয় সাপোর্ট দিয়ে থাকে। একজন সাইকোলজিস্টের প্রথম নৈতিকতা হলো তথ্য গোপন রাখা। নির্ভয়ে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে নিজের বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিস্ট নেওয়া না হলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে