বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নাগরিক আন্দোলন বারবার গড়ে উঠছে কেন?

শাসকশ্রেণিকে ভুলে গেলে চলবে না সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি- 'আপনি কিছু লোককে সব সময় বোকা বানাতে পারেন এবং মানুষকে কিছু সময় বোকা বানাতে পারেন, কিন্তু আপনি সব সময় মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন না।'
এন ইউ প্রিন্স
  ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
নাগরিক আন্দোলন বারবার গড়ে উঠছে কেন?

নাগরিক আন্দোলন বারবার গড়ে উঠে কেন? আসলে নাগরিকদের মনে যখন বিভিন্ন অসন্তোষ দানাবাঁধে, যখন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদের ভাষা খুবই ক্ষীণ বা দুর্বল পর্যায়ে চলে যায় বা শাসকদের চাপে পিষ্ট হয়ে যায়, তখনই নাগরিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। তখনই নাগরিকরা রাস্তায় নামে। চিৎকার করে তাদের চাহিদার কথা, তাদের দাবির কথা বলতে থাকে। উলেস্নখ্য, রাজনৈতিক আন্দোলনকে যত সহজে দমানো যায়, নাগরিক আন্দোলনকে দমাতে শাসকশ্রেণিকে একটু বেশিই বেগ পেতে হয়। কারণ, এখানে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা বা অংশগ্রহণ থাকে। অনেক সময় শাসকশ্রেণি এই আন্দোলন দমাতে সমর্থ হয়, আবার এই আন্দোলনই গণআন্দোলনে রূপ নিলে বা আন্দোলনের সময় দীর্ঘ হলে শাসকশ্রেণিকেও তখন পরাজিত হতে হয়। কারণ আন্দোলন যত দীর্ঘ সময় ধরে চলমান থাকবে সেখানে জনগণের সম্পৃক্ততা তত বাড়বে। আর জনগণ যত বেশি সম্পৃক্ত হবে তত বেশি পরিমাণে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে পারবে। যার উদাহরণও আমরা দেখেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া আরব বসন্ত, বর্ণবৈষম্য ইত্যাদি আন্দোলনের মাধ্যমে। সামান্য ইস্যু থেকে ক্রমে ক্রমে বিস্ফোরিত হয়েছে সেইসব আন্দোলন। অবশেষে শাসকশ্রেণিকে পর্যন্ত পরিবর্তন হতে হয়েছে সেই আন্দোলনের জন্য।

আবার এই দুই আন্দোলনের আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে এর মতাদর্শগত দিকে। রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক। যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্যই থাকে শাসকশ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা, অপরদিকে, শাসকশ্রেণির লক্ষ্য থাকে বিরোধী দলগুলোকে দমন করা। যার জন্য এই আন্দোলনগুলোতে শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক লক্ষ্য বা আদর্শের জন্য দলমতনির্বিশেষে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ কম হয়ে থাকে। তাই এই আন্দোলনগুলো প্রায়ই দলীয় সমর্থক বেইসড বা নির্দিষ্ট ক্যাম্পাস বেইসড বা দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠন বেইসড এর মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে, নাগরিক আন্দোলনের কলেবর আরো বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত। নাগরিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে নাগরিকের মৌলিক দাবি অথবা নাগরিকের সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাহিদা বা দাবির মধ্য দিয়ে কিন্তু এর পরিণতি অনেক সময় ক্ষমতা কেন্দ্রিক লক্ষ্যেও মোড় নিতে পারে। কিন্তু কথা ছিল নাগরিকদের দাবি বা চাহিদাগুলোকে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি সচেতন জনগণই আন্দোলনের মাধ্যমে শাসকদের থেকে আদায় করবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যখন নাগরিকের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হয় তখনই জনগণ নিজেদের অধিকার আদায়ে নিজেরাই রাস্তায় নামে। নিজেদের দাবি নিজেরাই আদায় করতে বদ্ধপরিকর হয়। আর এর জন্যই নাগরিক আন্দোলনে সমর্থন থাকে দলমতনির্বিশেষে সব সাধারণ মানুষের। সব মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে ওঠে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই আন্দোলন রূপান্তরিত হয় একটি বড় গণ-আন্দোলনে। জনগণ যখন দেখে রাষ্ট্রে বিভিন্ন অসংগতি দানাবেঁধেছে বা নাগরিক স্বাধীনতার হরণ হচ্ছে বা তাদের অধিকারের ব্যত্যয় ঘটছে, তখন জনগণ তা মেনে নিতে পারে না। জনগণ অন্যায়ের বিপরীতে ফুঁসতে থাকে। এক সময় তাদের ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নেয়। নাগরিক আন্দোলনকে আবার যদি দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখা হয় বা প্রলম্বিত করা হয় তখন এই আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিও পাল্টাতে থাকে। সাধারণ দাবি থেকে শক্ত দাবি আদায়ের দিকে জনগণ ঝুঁকতে থাকে। অর্থাৎ তখন শাসকশ্রেণি আরো বিপদের মধ্যে পড়ে যায়। এমনকি শাসকশ্রেণির অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। কারণ জাগরিত জনগণকে সামাল দেওয়া ক্ষমতাসীন শাসকের পক্ষে তখন সম্ভব হয় না। কারণ ততক্ষণে জনগণের কাছে শাসক তার বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলে। তখন শাসক রাষ্ট্রের সব উপাদান ব্যবহার করেও এই উত্তাল জনগণকে শান্ত করতে বা প্রভাবিত করতে পারে না। কারণ শাসক জনগণকে দেখে একভাবে, এক দৃষ্টিকোণ থেকে, কিংবা জনগণের দাবিকে বিচার করে তার নিজস্ব মতাদর্শের মাপকাঠির মাধ্যমে, প্রভাবিত করতে চায় নানা যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে কিন্তু এর বিপরীতে জনগণ যে শাসককে দেখে হাজার হাজার চোখে ও হাজারওভাবে; শাসককে বিচার করে শতসহস্র মতাদর্শের মাপকাঠিতে- এটা প্রায়ই ক্ষমতায় থাকা শাসকরা ভুলে যায়! এক সময় শাসককে পরাজিত হতেই হয়। কারণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে তো জনগণই; জনগণই দেশের প্রকৃত বিচারক আর জনমতই প্রকৃত রায়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭নং অনুচ্ছেদ বলে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণই নির্ধারণ করে কে বসবে ওই শাসকের চেয়ারে! জনগণই তার ক্ষমতা কিছু সময়ের জন্য দেয় শাসকের হাতে! কিন্তু ক্ষমতায় থাকা শাসকশ্রেণি যখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে তখন সেই শাসককে জনগণ আর বিশ্বাস করতে চায় না। তখন তার মাশুলও শাসককে দিতে হয় ভয়াবহভাবে। জনগণ তার সেই ক্ষমতাকে কেড়ে নেয় ও শাসককে নিন্দা করে, এমনকি তীব্রভাবে ঘৃণা করে। আরো একটা বিষয় উলেস্নখ্য, জনগণ বা নাগরিক সব সময় চুপ থাকে বা শাসকের ন্যায়-অন্যায় সব কৃতকর্মই মেনে নেয়- এর মানে এই নয় যে, জনগণ দুর্বল বা ভীত। জনগণের চুপ থাকার অর্থ এই নয় যে, জনগণ শাসকের কিছু দেখে না বা জানে না। আসলে জনগণ সবই দেখে, সবই বুঝে। কারণ পৃথিবীতে সবকিছুই রেকর্ডেড। শাসক যত গোপনেই যত অন্যায়, অনিয়ম বা ক্ষমতার অপব্যবহার করুক না কেন তার ফল তাকে সময়ের ব্যবধানে পেতেই হয়। পথিক যেই পথ দিয়েই হাঁটুক না কেন বা যত নীরবেই তার হাঁটা হোক না কেন, তার পায়ের ছাপ তো থাকবেই। তবে জনগণ সব সময় রিঅ্যাক্ট করে না। যখন বৈষম্য চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়, জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় তখনই সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আর বিদ্রোহী জনতা মানেই হচ্ছে সে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। তার প্রস্তুতি এমন থাকে যে, জীবন দেবে তবু তার অধিকার আদায় না করা পর্যন্ত পিছপা হবে না। আর যদি কখনো শাসকশ্রেণি এটা ভুলে গিয়ে তারই জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে তাহলে জনগণের একতার সামনে শাসকের অনুগত সশস্ত্র ও শৃঙ্খলিত বাহিনীও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যার উদাহরণ অতীত ইতিহাসে অহরহ রয়েছে- যা আমরা বিগত সময়ে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে তৎকালীন এ দেশের শাসকের পরাজয়ের মাধ্যমে দেখে এসেছি।

1

শাসকশ্রেণিকে ভুলে গেলে চলবে না সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি- 'আপনি কিছু লোককে সব সময় বোকা বানাতে পারেন এবং মানুষকে কিছু সময় বোকা বানাতে পারেন, কিন্তু আপনি সব সময় মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন না।'

অর্থাৎ জনগণ জেগে উঠবেই। জনগণ জেগে উঠবে তার অধিকার আদায়ের জন্য, জনগণ জেগে উঠবে ও চিৎকার করবে তার ন্যায্যতার জন্য। এই চিৎকারকে আপনি কোনো অস্ত্র দিয়ে, কোনো শক্তি দিয়ে বা বলপূর্বক আবদ্ধ করে রাখতে পারবেন না। জনগণকে আপনি যত চাপে রাখবেন তার মনে তত ক্ষোভের জন্ম হবে, আর জনগণ যখন এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করবে তখন তার আগুনে আপনি, আপনার ক্ষমতা ও দম্ভ জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে।

এন ইউ প্রিন্স : শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে