কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা মাসব্যাপী আন্দোলন করেছে নিজেদের যৌক্তিক অধিকার বাস্তবায়ন করার জন্য। অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কখনো ঘাতকের থাবার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কখনো পুলিশের লাঠিপেটা কিংবা গুলির সম্মুখীন হয়ে জীবন দিতে হয়েছে। তারা দুর্বার বেগে পদাঘাতে পাথর সমান বাঁধা ভিঙিয়ে বিজয়ের ছোঁয়া পেয়েছে। দেশকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে সেই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। তার জন্য শিক্ষার্থীদের নিজেদের পড়ালেখা থেকে একটু দূরে থাকতে হয়েছে। দেশের সংকটময় সময়ে ছাত্ররা আশার আলো হয়ে জাতির সামনে হাজির হয়েছে। এই আলোকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমার, আপনার তথা আমাদের সবার।
একটি দেশ কতটা ঝঞ্জাটে থাকলে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা বলবৎ রাখে। এর পাশাপাশি প্রশ্নফাঁসের নেপথ্য ঘটনা তো বেদনাদায়কই বটে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যোগ্যতার বলয়ে চাকরি পাচ্ছে না। অদৃশ্যশক্তি হাতিয়ে নিচ্ছে দেশের সেরা জায়গাগুলো তা মানা যায় না। অনেক সময় শোষকের শোষণের ফলে কথা বলা যায় না। বাকস্বাধীনতা জব্দ করা হয়। তা একটি স্বাধীন জাতির বড় পরাধীনতা হবে না তো কি হবে?
স্বাধীনতা থেকে দূরে থাকতে থাকতে একটা সময় ঝঞ্জাট ভাঙার বিস্ফোরণের বলয় সৃষ্টি হয়। সেই বিদ্রোহের শক্তি আশার পথ দেখায় দেশের নাগরিককে। যারা বিভিন্ন কারণে কথা বলতে পারে না, তারা নির্ভয়ে সমর্থন দিয়ে যায় যারা দেশের হয়ে কথা বলে। সংগ্রাম করে ও জীবন দিয়ে দেয় দেশ মাতৃকাকে অন্যায়-অনাচার থেকে উদ্ধার করতে।
ছাত্ররা প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে তা রূপ নেয় অলিখিতভাবে রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনে। কারণ দেহের বাকি অংশ অসুস্থ রেখে একটিকে সুস্থ করলেই দেহের শান্তি ফিরে আসে না বরং একটা সময় ঐ সুস্থ অংশটিরও পচন ঘটে। তখন চাইলেও আর ভালো করার উপায় তেমনটা থাকে না। ছাত্রদের এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফল হবে তখনই যখন রাষ্ট্র মেরামত হবে। জনগণ শান্তিতে নীড়ে ঘুমাতে পারবে, রাস্তাঘাটে মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে। সাংবাদিকেরা সত্য খবর তুলে ধরতে পারবে। এমনকি সবাই দেশের সত্য খবর সহজে জানতে পারবে।
এর জন্য দরকার আইনের শাসন, যার জন্য আমাদের সংবিধানের ৮০ থেকে ৯১নং অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের বিকল্প নেই। আমাদের সংবিধান বিগত বছরে অনেকগুলো অনুচ্ছেদ পরিবর্ধন করা হয়েছে ক্ষমতাশীনদের সুবিধার জন্য। সংবিধানকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এরশাদের শাসনে এরশাদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা পরপর দুইবারের বেশি হতে পারবে না বলে সংবিধানে বিধি পাস করেন- যা একটি জাতির জন্য ভালো দিক বয়ে আনল। তদ্রম্নপ আমাদের প্রধানমন্ত্রী হওয়া যেন পরপর দুইবারের বেশি না হওয়া যায় সেই দিক নিয়েও ভাবতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে সংবিধান পরিবর্তন করা এখন সময়ের দাবি।
ঘাতকের থাবার সম্মুখীন হতে হতে মানুষ ধরতে পারে সত্য-মিথ্যা পার্থক্য, বুঝতে পারে কোনটা মায়াকান্না কোনটা ছলকান্না। হৃদয়পটে বোধগম্যের পর্দা সৃষ্টি হয় কোনটা দেশের জন্য কাজ, কোনটা চাটুকারিতার কাজ। এতসব পার্থক্যের মধ্য দিয়ে দেশ চলতে গিয়ে একটা সময় মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সেই প্রতিবাদটুকু করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে শাসকের নির্মম শোষণের মুখে পড়তে হয়, জলাঞ্জলি দিতে হয় সুন্দর প্রবাহ জীবনও বটে। শুধু দেশমাতৃকার কথা চিন্তা করে। কাউকে চিরতরে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়। দেহের চলে যাওয়া ঘটলেও সেই সব মানুষগুলো জনসাধারণের কাছে বীর হিসেবে রয়েছে যায়। একটা সময় এভাবে দেশকে সংস্কার করতে ছাত্র-জনতা গণঅভু্যত্থান শুরু করে। সেই গণঅভু্যত্থান রূপ নেয় স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়েও বাঙালিরা তাদের ন্যায্য স্বাধীনতা থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত হয়েছে। কাগজে-কলমে আইন বিধি থাকলেও বাস্তবে তা যেন হয়ে উঠেছে কারো জন্য শূন্যতায় ঘেরা। 'আপস না সংগ্রাম' এমন নানাবিধ স্স্নোগানে দীর্ঘ এক মাসের প্রতিবাদী কণ্ঠে ছাত্ররা অর্জন করে স্বৈরাচার পতনের দাবি। সেই দাবিটি হয়ে উঠল ছাত্রদের থেকে সাধারণ জনগণের বিজয়ের মহানিশা প্রতীকীচিত্র। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আগামীতে ছাত্রদের চাওয়া কি পাওয়াতে পূরণ হবে? নাকি নতুন স্বৈরাচারের জন্ম হবে?
১৭ বছর একটি দল দেশকে ভরাডুবিতে নিয়ে গেল। আরেকটি প্রধান দল বিগত ১৭ বছর বিতৃষ্ণায় রইল। তারা কি ক্ষমতায় আসলে বিতৃষ্ণা মেটাবে ? নাকি দেশ ও দশের কথা ভাববে। তা দেখার অপেক্ষায় রইল ছাত্ররা। ছাত্ররা এমন দলকে ক্ষমতায় চাই যারা মানুষের কথা ভাববে, ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়বে। ছাত্ররা দেশকে ঘাতক থেকে উদ্ধার করলেও, চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে তখনই যখন দেশের মানুষ সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতা পাবে। স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে কোনো সরকার ব্যর্থ হলে ছাত্ররা আবার গণজাগরণ সৃষ্টি করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এছাড়া আমাদের পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণ করা হয়েছে বহুদিন ধরে। যার ফলে পুলিশ হয়েছে জনগণের মূল শত্রম্ন। পুলিশকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। গতকাল (৭ই আগস্ট ২০২৪) পুলিশ যে ১১ দফা দাবি করল তা বাস্তবায়ন করতে হবে। পুলিশের কিছু সদস্যদের জন্য পুরো পুলিশ বাহিনী জনগণের রোষানলে পড়ুক তা কেউ চাই না। এই জন্য যারা দলীয়করণের সুবিধা নিয়ে পুলিশে ডুকল তাদেরকে প্রত্যাহার করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যে সকল পুলিশ বিতর্কিতভাবে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাল তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সর্বোপরি যারা গুলি করতে হুকুম দিল তাদেরকে আইনের মুখোমুখি করতে হবে। মানুষের মাঝে ফিরিয়ে আনতে হবে... পুলিশ জনগণের বন্ধু।
আমাদের বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিচার বিভাগে রাজনীতির বলয়ে অনেক বিচারক প্রবেশ করে যারা আইনের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছে তাদের উপযুক্ত যায়গা থেকে সরাতে হবে। নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মানুষ ন্যায় বিচার পাবে। আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় অযাচিত বক্তব্যের কারণে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। প্রধান বিচারপতি বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তারও বিচার করতে হবে বলে ছাত্ররা মনে করে।
একটি দেশ উন্নত হওয়ার জন্য যে কয়েকটি উপাদান থাকা দরকার তার মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাকে এড়িয়ে গিয়ে দেশের উন্নতির ছোঁয়া পাওয়া যায় না। দেশের সফলতার ছোঁয়া বাতলে দেওয়া যায় না। বাজেটে শিক্ষাখাতের যৎসামান্য বরাদ্দ দেশ মাতৃকার জন্য ভালো লক্ষণ বয়ে আনতে পারে না। বছরের পর বছর জাতীয় বাজেটে আমরা শিক্ষাখাতকে অবজ্ঞা করেছি। যার ফলে দেশে যেমন গবেষণাবান্ধব পরিবেশ নেই কিংবা থাকলেও গুণগত ও পরিমাণগত ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটেিত অনতিবিলম্বে প্রশমনের পথে গিয়ে শিক্ষাখাতে গবেষণাকে জোর দিতে হবে।
রপ্তানি, আমদানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, মুদ্রাস্ফীতির যে বাজে অবস্থা তা থেকে উৎরানোর জন্য দেশের স্থিতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই। বৈদেশিক ঋণের বোঝা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ছুঁইছুঁই। অর্থনীতির এই দুরাবস্থার ক্রান্তিলগ্নে একজন দক্ষ লোক দরকার যিনি এই সমস্যাগুলো থেকে দেশকে বাঁচাতে পারবে। ড. মুহাম্মদ ইউনুস যেন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হয়ে দেশকে উদ্ধার করার যোগ্য দাবি রাখে। আশা করি, সেই দিকে হাঁটবে দেশ। তরুণদের পছন্দের ইউনুসই হবেন দেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার প্রধান।
ছাত্ররা যে আলোর পথ দেখিয়েছে, নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শিখিয়ে সেই পথকে করতে হবে আলোকিত। আলোকিত করতে হলে যোগ্যদের যোগ্যস্থানে বসাতে হবে। তাহলে জনগণের চাওয়ার প্রতিফলন হবে। দেশের অর্জন আরও বেগবান হবে। এভাবে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশটি সম্মানে অমলিন থাকবে। ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ যেন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল।
রাসেল হোসেন : নবীন লেখক