বর্তমান সময়ে সমাজে কিশোর গ্যাং কালচারের উত্থান উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। সাধারণত শহুরে এলাকাগুলোতে বেশি দেখা গেলেও এই সমস্যা এখন গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। 'কিশোর গ্যাং' বলতে কিশোর বয়সি ছেলেমেয়েদের এমন এক দলকে বোঝানো হয়, যারা মিলে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে এবং নিজেদের শক্তি প্রদর্শন ও ক্ষমতার দাপট দেখায়। কিশোরদের গ্যাং সংস্কৃতি একটি সামাজিক সংকট হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, যা শুধু কিশোরদের নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য একটি বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছে। কিশোর গ্যাং কালচারের জন্ম ও প্রসারের পেছনে রয়েছে অনেক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ। প্রথমত, পারিবারিক অবহেলা ও দারিদ্র্য অনেক সময় কিশোরদের অপরাধের পথে ঠেলে দেয়। সমাজের নিম্নবিত্ত বা বস্তি এলাকাগুলোতে কিশোরদের পরিবারে অর্থনৈতিক সংকট, বৈরী পরিবেশ এবং শিক্ষার অভাব থাকে। ফলে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পেয়ে তারা বন্ধুত্বের খোঁজে অপরাধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারে পিতামাতার বিচ্ছেদ বা পর্যাপ্ত সময় না দেওয়ার ফলে মানসিক ও আবেগগত শূন্যতা তৈরি হয়, যা কিশোরদের ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। এ ছাড়া মাদকাসক্তি, অপরাধমূলক চলচ্চিত্র, ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকান্ড দেখে কিশোররা সহজেই গ্যাং সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধসমূহ অত্যন্ত ভয়াবহ। এর সদস্যরা প্রায়ই চুরি, ছিনতাই, মাদকপাচার, মারামারি এবং সহিংস কর্মকান্ডে জড়িত থাকে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিতভাবেই এসব গ্যাংয়ের সংঘর্ষ ঘটে থাকে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে অপরাধে অংশগ্রহণ করে এবং অন্য গোষ্ঠীর সদস্যদের আক্রমণ করে। এতে আহত, নিহত বা পঙ্গুত্ব বরণ করার ঘটনা ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ জনগণ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে এবং সমাজের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্যাংগুলোর অপরাধমূলক কার্যক্রম কিশোরদের জীবনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং সমাজের শান্তিশৃঙ্খলাকে ব্যাহত করছে। পাশাপাশি এর প্রভাব সমগ্র সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্কুল ও কলেজগুলোতে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ ধরনের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা অপরাধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। কিশোর বয়সকে বলা হয় জীবন গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়টাতে কিশোররা বিভিন্ন ধরনের মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এ বয়সে তারা সহানুভূতি, বন্ধুত্ব এবং সামাজিক সম্মান লাভের চেষ্টা করে। সমাজে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের অন্যতম কারণ হলো, কিশোরদের মধ্যে সামাজিক স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা। গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে তারা নিজেদেরকে 'শক্তিশালী' ও 'বীরত্বপূর্ণ' হিসেবে প্রমাণ করতে চায় এবং সমাজে আলাদা একটি পরিচিতি তৈরি করতে চায়। তবে এসব কিশোরের অধিকাংশই আসলে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছে। তারা সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। অনেকেই গ্যাংয়ের অংশ হয়ে শক্তি প্রদর্শন, প্রতিশোধ নেওয়া বা নিজেদের গোষ্ঠীকে রক্ষা করতে চায়। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের সহিংস মানসিকতা গড়ে ওঠে, যা ভবিষ্যতে তাদের জীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং অপরাধ দমনের জন্য আইন ও প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে আইন কার্যকর না হওয়ায় এবং বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় কিশোর গ্যাং কালচার দমন করা বেশ কঠিন। অনেক সময় কিশোরদের অপরাধমূলক কান্ডে আইনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ থাকে, যা কিশোরদের শাস্তি থেকে মুক্ত রাখে। তবে সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে কিশোর গ্যাংদের দমন করতে চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং সংঘর্ষ প্রতিরোধের জন্য শহরগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তবে শুধু পুলিশি ব্যবস্থা নয়, বরং একটি নীতি ও সামাজিক সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন এবং সামাজিক সংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করতে পারে। প্রথমত, পরিবারের উচিত তাদের সন্তানদের প্রতি সঠিক যত্ন এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করা। পিতামাতাকে সন্তানদের মানসিক ও আবেগগত সমস্যার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং আস্থা তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। স্কুল ও কলেজগুলোতে কিশোরদের মাঝে নৈতিক শিক্ষা প্রদান, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং দলগত চেতনা জাগ্রত করার জন্য নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজন করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদেরও এসব অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে, যা কিশোরদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে সহায়ক হবে। তৃতীয়ত, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। কিশোর গ্যাং কালচার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মশালা, আলোচনা সভা এবং প্রচারণামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করা দরকার। তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সামাজিক সংগঠনগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কিশোরদের মধ্যে ইতিবাচক মূল্যবোধ প্রচার করতে পারে। চতুর্থত, আইন প্রয়োগে দৃঢ়তা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথ এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িতদের দ্রম্নত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে অন্য কিশোররা এ ধরনের কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার আগে ভেবে দেখে। পাশাপাশি কিশোরদের পুনর্বাসনের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা পুনরায় সমাজে সুস্থ ও সৎ জীবনযাপনের সুযোগ পায়। কিশোর গ্যাং কালচার একটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে, যা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা সমাধান করা সম্ভব নয়। এটি প্রতিরোধে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। কিশোরদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব। কিশোর গ্যাং কালচারের সামাজিক প্রভাব, পারিবারিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ জীবনের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা আমাদের সবার সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিরোধ করতে হবে। সমাজে সুশাসন এবং নৈতিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিলে এই সংকটের সমাধান সম্ভব।
হৃদয় পান্ডে
শিক্ষার্থী
ঢাকা কলেজ