সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী রাজনীতিতে সতর্কতা জরুরি

মুহাম্মাদ রিয়াদ উদ্দিন
  ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী রাজনীতিতে সতর্কতা জরুরি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এলিট শ্রেণির প্রভাব প্রতিপত্তি স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে একটি চলমান প্রক্রিয়া। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্যারেটা তার 'দ্যা মাইন্ড এন্ড সোসাইটি' গ্রন্থে বলেন, এলিট হচ্ছে এমন একটি জনসমষ্টি যারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ। তার মতে, এলিট শ্রেণি সাধারণের তুলনায় সংখ্যালঘু হলেও সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত পারঙ্গম। এই এলিট সংখ্যালঘু শ্রেণি গণতন্ত্রকে পুঁজি করে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করে এজন্য পেস্নটো বলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে সংখ্যালঘুদের শাসন ব্যবস্থা। প্যারেটা তার বইয়ে এলিট শ্রেণিকে দু'ভাগে বিভক্ত করেছেন : ১. শাসক এলিট ও ২. অশাসক এলিট। শাসক এলিট শ্রেণি বাংলাদেশের রাজনীতির ফায়দা গ্রহণ করেন বেশি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এরা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়, দামি গাড়ি, বাড়ি গড়ে। এমনকি দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে। কানাডাতে বেগম পাড়া বানায়। তাদের ছেলেমেয়েকে ভিনদেশের কৃষ্টি-কালচারে গড়ে তুলে। দেশের প্রতি এদের কেবল লুটপাটের দায়িত্বটুকু আমরণ থাকে। এই ধরনের শাসক এলিট শ্রেণি নিজেদের স্বার্থের বাইরে কোনো কিছুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। এই শাসক এলিট শ্রেণি ক্ষমতার মোহমুগ্ধতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে খুন করে বাংলাদেশের সোনালি স্বাধীনতার কফিনে প্রথম পেরেক মারে। অপরদিকে অশাসক এলিট শ্রেণিও কোনোমতে কম নয়, এরা ক্ষমতাবানদের নৈকট্য লাভ করে। শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন ও বহালে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষায় এরা সদা তৎপর থাকে।

মস্কো তার 'দ্যা রুলিং ক্লাস' গ্রন্থে বলেন, শাসক (এলিট) শ্রেণি সব সময় সংখ্যায় স্বল্প হয়, কিন্তু তারাই সমস্ত প্রকার রাজনৈতিক কার্যসম্পাদন করে থাকেন। এই শ্রেণি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখে এবং রাষ্ট্রের সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। অথচ শাসিত শ্রেণি সংখ্যায় বেশি হলেও তারা শাসক শ্রেণির দ্বারা সব সময় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসও অনুরূপ কর্মকাঠামোর ভিত্তিতে পরিচালিত। রাজনৈতিক ময়দানে নিরন্তর এলিট শ্রেণির দৌরাত্ম্য। অথচ সমকালীন রাষ্ট্রদর্শন ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগ্যবাদের সারকথা হলো, সর্বাধিক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত করা কিন্তু বাংলাদেশের মতো কথিত গণতান্ত্রিক দেশে এই তথ্যের বৈপরীত্যই বেশি কার্যকর। এখানে সমকালীন রাষ্ট্রদর্শন ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগ্যবাদের সারকথা হলো, শাসক তথা এলিট শ্রেণির জন্য কেবল সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত করা। অন্যদের ক্ষেত্রে, বোবার মতো বাঁচো অর গো টু দ্যা হেল! বাংলাদেশ বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে যে একটা ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র গঠন করে তার মূলনীতি হলো চারটি। ১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র এবং ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এলিট শ্রেণি সাধারণের মাঝে একটা না একটা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে তাদেরকে তাতে নিমগ্ন রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথ সুগম করে। বিশেষ করে তারা চার নম্বর মূলনীতি তথা ধর্মের মতো একটা সফট জিনিসকে সহজে বেছে নেয় এবং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে তারা সফলকাম হয়। এমনকি এলিট শ্রেণির রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের কারণে চারটি মূলনীতির একটিরও সুষম বিকাশ নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্বে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রট নির্বাচন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তীকালেও এই এলিট শ্রেণির রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যে এদেশের সোনালি ইতিহাস যেন ম্স্নান মায়ের মুখ। এই জন্য জন সিলি বলছেন, ইতিহাস ছাড়া রাজনীতি ভিত্তিহীন আর রাজনীতি ছাড়া ইতিহাস মূল্যহীন। অর্থাৎ, বাংলাদেশ রক্তঝরা এক ইতিহাসের মাধ্যমে রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেলেও এলিট শ্রেণির অপরাজনীতির কবলে আজ সে ইতিহাস মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার আগেই আজকাল এলিটদের বাচ্চা-কাচ্চারাও রাজনীতি তথা দেশ শাসনে নেমে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এজন্য বোধহয় পেস্নটো তার 'রিপাবলিক' গ্রন্থে বলেছেন, যারা দেশ শাসন করবেন তাদেরকে ৫৫ বছর বয়স অবধি জ্ঞানচর্চার পরামর্শ দেন। নিকালো ম্যাকিয়াভেলি তার 'দ্যা প্রিন্স' গ্রন্থে রাজ্য শাসনাধীন রাখার দু'টি তাৎপর্যময় প্রথা উলেস্নখ করেন। ১. বিজয়ীদের সহচরদেরকে মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী পদে উন্নীত করে বিজিত রাজ্য শাসন করা এবং ২. বিজিত রাজ্যের সম্ভ্রান্ত সম্প্র্রদায়ের যারা বংশানুক্রমে আভিজাত্যের দাবিদার তাদের সহযোগিতায় দেশ শাসন। এইখানে তাদের মাঝে চোর-ডাকাত সব এলিটের কথা তিনি বলেননি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যখনই ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়, তখনই এলিট শ্রেণিরা যে দলেরই হোক না কেন অল্প কিছু চিহ্নিত নেতাকর্মী ভিন্ন অন্যরা বিজয়ী দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে সংযুক্ত হয়ে শোষণের পুরানো পথটাই বেছে নেয়। ফলে রাষ্ট্র শাসন ও আদর্শিক লড়াইয়ের জায়গায় বড় ধরনের একটা সংকট তৈরি হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে শাসক শ্রেণির পরিবর্তন হলেও শোষকের পরিবর্তন হতে দেখা যায় না। তাই গণ-অভু্যত্থান পরবর্তীতে পুরানো শোষক এলিট শ্রেণির সঙ্গে পুনর্বাসন না ঘটে সেদিকে সতর্ক থাকা জরুরি।

মুহাম্মাদ রিয়াদ উদ্দিন

শিক্ষার্থী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে