বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নিরপেক্ষ নির্বাচন ও রাজনৈতিক সচেতনতা

দেশের রাজনীতিতে যদি রাজনৈতিক দলগুলো আর্দশ চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে না পারে তাহলে যত সংস্কার করা হোক না কেন, প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে না।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নিরপেক্ষ নির্বাচন ও রাজনৈতিক সচেতনতা

একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে ১৯৯০, ২০২৪-এ গণ-অভু্যত্থান হয়েছে। গণ-অভু্যত্থানের আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। ১৯৯০-এর আন্দোলনের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। '৯১, '৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮, ২০২৪ এই নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণ করা দরকার। '৯১-এর পূর্বে যে নির্বাচন হয়েছে, তা সেনা সরকারের অধীন। তাই সেগুলো নিয়ে আলোচনা না করাটাই ভালো। তাই '৯১-এর পূর্বের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করার দরকার আছে বলে মনে করি না। '৯১-এর নির্বাচন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব মুক্ত একটি নির্বাচন। এই নির্বাচন হয়েছে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের অধীনে। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ভোট চুরির বিষয়টা ছিল না। তবে যারা স্বৈরাচার এরশাদের পতনের জন্য রাজপথে আন্দোলন করেছিল, সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসন পায়নি। এরশাদ পতনের আন্দোলনের মূল কারিগর ছিল বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো। জাসদ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ফেডারেশনসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা এরশাদের পতন এবং তার পরর্বর্তী সময়ে নির্বাচনগুলো কেমন হবে তার একটি রূপ রেখা দিয়েছিলেন। এই রূপরেখার কোনোটিই মানা হয়নি পরবর্তী সময়ে নির্বাচনগুলোতে। আর '৯১-এর নির্বাচনে বাম সংগঠনগুলো কোনো আসন পায়নি। এত বড় একটি গণ-অভু্যত্থান যারা ঘটালো তাদের কোনো প্রতিনিধি পার্লামেন্টে যেতে পারেনি। তার কারণ কি? '৯১-এর নির্বাচনটিতে ব্যক্তি পরিচয়, প্রচার প্রচারণার খরচ ছিল মুখ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে ভোট কেনার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। এ দেশের বাম সংগঠনগুলোর পক্ষে এত আর্থিক ব্যয় করে নির্বাচন করাটা সম্ভব না। কারণ বামদের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। এ দেশের অধিকাংশ সাধারণ নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনার অভাব রয়েছে। তাই এদের নানা লোভে প্রলোভিত করা যায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহারে হয়। যদিও ৯৬ সালের নির্বাচনটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। তবে এই নির্বাচনেও ধনীরা নির্বাচিত হয়ে পালার্মেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেন। নানা আন্দোলনের পর ওয়ান এলিভেনের সরকারের অধীন ২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। চুলচেরা বিশ্লেষণে এই নিবার্চনে ত্রম্নটি বিচু্যতি পাওয়া যাবে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন ব্যবস্থাটি বাদ দিয়ে দেন। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন ব্যবস্থাটি বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় আদালতের মাধ্যমে, নির্বাচিত পার্লামেন্টে নয়। যার ফলে, দেশের বিচার ব্যবস্থাটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় আওয়ামী লীগ আমলে। নানা সূত্র থেকে যতদূর জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সংসদে আইন করে বাদ দেওয়ার কথা হয়েছিল। ওই সময় আইন ও সংসদ বিষয়ক কমিটির সভাপতি ছিলেন দেশের বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। তিনি এই আইনটি (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন) বাদ দিতে অসম্মতি জানান। ফলে, সরকার বিচার বিভাগের মাধ্যমে এই আইনটি বাতিল করার ব্যবস্থা করা হয়। যার ফলে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও নিজ দলের সরকারের হাতে বহুবিধ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ২০১৩, ২০১৮, ২০২৪- এই তিনটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন। ২০২৪ সালে ১০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। '১৩ ও '১৮ নির্বাচনের ভোট হয়েছে রাতে। সকালে একটি প্রহসন করে বিকালে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। কেন এমন হলো নির্বাচন? তার জন্য দায়ী কারা তা তদন্ত করে বের করা প্রয়োজন। এর জন্য শুধু আওয়ামী লীগই দায়ী না। নির্বাচন কমিশনের সব ধরনের কর্মীরা দায়ী। কেন ক্ষমতাসীনরা এ ধরনের নির্বাচন করতে পারে? তার কারণ দেশের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষের রাজনৈতিক জ্ঞান নেই বা গণতন্ত্র বুঝে না। এমএ পাস করা একজন ব্যক্তি যখন বলে হাসিনা টাগেট করেছে এবার মানে ২০২৪ সালের নির্বাচনে। রাজশাহী সদর আসনটি তার শরিক দলের মাধ্যমে বিজয়ী ঘোষণা করে নিয়ে নেবে। এই বিষয়টি যে অন্যায় তা তিনি বুঝেছেন কি? বুঝলে তার প্রতিবাদ করতেন। বরং এর পক্ষে নানা যুক্তি দেন। তিনি নিউমার্কেটে আড্ডা দেন এবং তিনি বলেন, এ ধরনের খবরগুলো তিনি উপরের মহল থেকে জেনেছেন। কারণ ওপরে নাকি তার অনেক জানা শোনা। আরকে জন বললেন, তিনি এই খবরটি ডিজিএফের কাছ থেকে নাকি জানতে পেরেছেন। এ ধরনের কর্মকান্ড যে নীতি গর্হিত- তা, নিজের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে এ দেশের কথিত শিক্ষিত নাগরিকরা বিচার করেন না। আর তা যদি তারা করতে পারত তাহলে ফ্যাসিবাদ শাসনযন্ত্রে জেঁকে বসত না। অর্ন্তবর্তী সরকার নানা ধরনের সংস্কারে হাত দিয়েছেন। এই সংস্কার কতটা সফল হবে? দেশে যদি দলকানা শিক্ষতরা অন্ধ ভক্তের মতো দুর্নীতিবাজকে সার্পোট করে। বর্তমান সরকার সম্পর্কেও এই আড্ডা দেয়া ব্যক্তিটি বলে থাকেন, তিনি নাকি খুব উপরের মহল থেকে নানা তথ্য পান। গণতন্ত্র আসলে কি? গণতন্ত্র কি তৃণমূল থেকে ওপর দিকে যাবে না ওপর থেকে তৃণমূলে আসবে? এই জ্ঞানটুকু এ দেশের কথিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রিধারীরা বুঝেন না। আর এদের অজ্ঞানতাই ফ্যাসিবাদী হতে পারে সরকার। আর এরা দল কানা হয় স্বার্থে। এই রাজনৈতিক মূর্খদের কথা শুনে সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা বুঝে না। শুধু সরকার না এ দেশের দলকানা কিছু মানুষের জন্যই রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারী হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে কোনো গণতন্ত্র নেই। শুধু দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিকগোষ্ঠীর না বামেদেরও। চাটুকার দ্ধারা পরিবেষ্টিত রাজনৈতিক দলের প্রধানরা। তার বিরুদ্ধাচারণ কেউ করলে চাটুকারা বিরুদ্ধাচারণকারীকে দল থেকে বের করে দেয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের তথা উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং রাজনৈতিক দল। ৫ আগস্ট গণ-অভু্যত্থানের পর এক ফুৎকারে নিভে গেল। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের নাম নিশানাটুকু দেখা যাচ্ছে না। হাসিনার পলায়নের পর কোনো চাটুকার তথা আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীকে মাঠে দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কি আওয়ামী লীগের মুক্তির মশাল নিভে গিয়েছিল? নিভে যায়নি, বরং তা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। কারণ, তৎকালীন নেতারা চাটুকার ছিল না। ব্যক্তি পূজারি রাজনীতিকে তারা বিশ্বাস করতেন না। তারা আর্দশভিত্তিক রাজনীতি করতেন। এখন দেখা যাচ্ছে যে, হাসিনা নেই আওয়ামী লীগ নেই। ১৯৭১ সালে মুজিব ছিল না আওয়ামী লীগ ছিল। তার কারণ হলো হাসিনা নিজেকে দেবতুল্য করে গড়ে তোলার জন্য কিছু চাটুকার তৈরি করেন। যার বিস্তৃতি গ্রামপর্যায় পর্যন্ত ছিল। আওয়ামী লীগের মূলনীতি কি তা কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত অনেক নেতাই জানতেন না। তারা ইয়া হাসিনা রব তুলতে পারতেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক নেতাই বলতে পারতেন না আওয়ামী লীগের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। তারা জানতেন বুঝতেন হাসিনাকে। ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর এক ফুৎকারে নিভে যায়। কারণ দলটির কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে উঠেনি ১৬ বছরে যা ছিল তাও স্বৈরাচার হাসিনা ধ্বংস করে দিয়েছেন। গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের কোনো সাংগঠনিক উন্নয়ন করেনি হাসিনা। তিনি যা করেছেন তার এবং তার অনুগত্য বাহিনীর আর্থিক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তিনি তার দলের নেতা কর্মীদের জন্য লুটপাটের দ্বারটি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। একজন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকে দেখা যায় ১৬ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক। তাহলে অনুমান করুন কেন্দ্রীয় নেতা কত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতি অনুশীলনের শ্রেষ্ঠ বিদ্যা পীঠ। প্রকৃতার্থে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে কি এসব চর্চা হয়? বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোতে তাদের অনুগত্য বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনো আর্দশ ও গণতন্ত্র চর্চা হতে দেখা যায়নি।

দেশের রাজনীতিতে যদি রাজনৈতিক দলগুলো আর্দশ চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে না পারে তাহলে যত সংস্কার করা হোক না কেন, প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে না।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে