সভ্য পৃথিবীতে মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হয়। নিজেদের প্রয়োজনেই সবাই রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে ১৫১৩ সালে ইতালির দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার 'দ্য প্রিন্স' শীর্ষক রচনাতে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র বা স্টেট শব্দটি ব্যবহার করেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টেটলের মতে 'রাষ্ট্র হলো স্বাবলম্বী ও পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে সংঘটিত কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি'। আর সমাজ বিজ্ঞানী অগবার্ন ও নিমকফ বলেছেন, 'রাষ্ট্র হলো একটি সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সার্বভৌম সরকার কর্তৃক শাসিত'। এছাড়াও, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। তবে, সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বলতে গেলে রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বোঝায়- যা কোনো একটি ভৌগোলিক এলাকা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে।
আর এই সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে মানুষ। অর্থাৎ মানুষ হলো রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক। যাদের সম্মিলনেই রাষ্ট্র গঠিত হয়।
এই প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলে রাখা ভালো। আধুনিক রাষ্ট্র বলতে আমরা যা বুঝি গ্রিক ও রোমান দার্শনিকরা তাকে যথাক্রমে পলিশ এবং সিভিটাস নামে অভিহিত করেছেন। ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো এই নামে পরিচিত। বৃহৎ রাষ্ট্রের ধারণা সর্বপ্রথম ব্যক্ত করেন টিউটনরা। রাষ্ট্রকে তারা স্ট্যাটাস নামে ঘোষণা করেন।
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, মানুষ রাষ্ট্র বানায় কিন্তু রাষ্ট্র মানুষ বানায় না। উদাহরণস্বরূপ ধরুন পৃথিবীর কোথাও অনাবাদি ভূখন্ড রয়েছে। যেখানে একজনও মানুষ নেই। সেখানে কি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠিত হবে? একদমই নয়। যেহেতু মানুষই নেই সেহেতু রাষ্ট্র গঠন ও সুন্দর, সুশৃঙ্খলভাবে রাষ্ট্রীয় কার্যবলি সম্পাদনের তো প্রশ্নই ওঠে না।
সুতরাং, এই বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, যেখানে মানুষ আছে সেখানে তাদের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, নিজেদের পরস্পরের মধ্যে শান্তিশৃঙ্খলার জন্য বিধিবদ্ধ আইন ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। আর তখনই রাষ্ট্রের দরকার হয়।
প্রথমে একক ব্যক্তি তারপর পরিবার, তারপর সমাজ ও সর্বশেষ রাষ্ট্র বা দেশের অবস্থান। যা মানুষ নিজেদেরই প্রয়োজনে গঠন করে থাকে।
রাষ্ট্রের গঠন কেমন হবে। আধুনিক রাষ্ট্র নাকি আদি রাষ্ট্র। জাতি রাষ্ট্র নাকি নগর রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে নানান আলোচনা থাকলেও আমরা বলব, রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ মানুষের জিম্মি হয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনী। যেখানে রাষ্ট্রের কাছে মানুষ কেবলই একটা নিরীহ প্রাণী মাত্র। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আদিষ্ট ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যবহার করে নিজেদের বৈধ সম্পত্তির মতো করে। আর সাধারণ জনগণের সঙ্গে আচরণ করেন দাসের মতো। সাধারণ মানুষ যেন কেবলই তাদের হাতের পুতুল।
রাষ্ট্রের এই সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে শাসন ও শোষণের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার গল্প অনেকটা প্রাচীনই। কারণ প্রাচীনকালে রাষ্ট্রের কাঠামো আজকের মতো না থাকলেও শক্তিমান সমাজপতিদের অবস্থান আজকের রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মতোই ছিল। যারা দুর্বল ও সাধারণ লোকদের শোষণ করেই চলতো দিনরাত্রি।
এই প্রসঙ্গে আধুনিক এই রাষ্ট্রের গোড়ার দিকে না গেলেই নয়। আর তাই কিছু কথা বলতেই হয় ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে। ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্র দর্শন ছিল বস্তুবাদী। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আধুনিক মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাই তাকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনকও বলা হয়। তিনি ক্ষমতা-রাজনীতির প্রথম প্রবক্তা। তিনিই প্রথম, যিনি জাতি ও রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। এমনকি তিনিই প্রথম চিন্তাবিদ, যিনি ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে ন্যায়সঙ্গত বলেছেন।
ম্যাকিয়াভেলি বিশ্বাস করতেন যে, রাজনীতিতে উদ্দেশ্য পবিত্র। অর্থাৎ, রাজনীতিবিদদের অবশ্যই তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, এমনকি যদি তা নৈতিকতার বিরুদ্ধেও হয়। মূলত তার এসব চিন্তা-ই শাসকদের শোষক হওয়ার পথ সুগম করে। সাধারণ মানুষের মনে এসব শোষকদের বৈধতা সৃষ্টি করে।
ম্যাকিয়াভেলিবাদের আক্ষরিক অর্থ হলো ধূর্ততা, কপটতা, তাড়না, ধোকাবাজি ও দ্বিমুখী নীতি। তিনি মনে করতেন, শাসককে সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, নিষ্ঠুরতা, চাতুরতা বা প্রতারণা যেভাবেই হোক না কেন, মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতে হবে। তিনি শাসককে প্রেম-ভালোবাসা, দয়া, নমনীয়তা এবং সহানুভূতিকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি যেই প্রেক্ষাপটে কিংবা যেই পরিস্থিতিতে যে যাই ভেবে বলুক না কেন। আমাদের আধুনিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব প্রাপ্তদের সেবক থেকে শাসক বানিয়েছে মূলত তার দেয়া তত্ত্বই। যেসবের অনুসরণের ফলে রাষ্ট্র প্রধান রাষ্ট্রকে নিজের সম্পত্তি মনে করতে থাকে। আর যাদের নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত সেইসব ক্ষুদ্র অংশ মানুষকে তার নিজের অধীনস্থ অনেকটা দাসের মতোই মনে করে। ফলে, তাদের শাসন করে ঠিক। সেটা শাসনে না থেকে শোষণে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ফলে, মানুষ অতিব প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রকে মনে করে অপ্রয়োজনীয়। যতদূর সম্ভব চেষ্টা করে এই নিয়মতান্ত্রিক বৈধ শোষণ ও নিপিড়ন থেকে দূরে থাকার জন্য।
আমরা যতই তাত্ত্বিক আলোচনা উপস্থাপন করি না কেন, সত্য হলো এটাই যে, ম্যাকিয়াভেলির দেখানো এই পথ অনুসরণ করে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন। দিনশেষে ফলাফল এটাই যে, সেবক থেকে শাসক হয়ে উঠবেন শোষক ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী জালেম।
মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম : কলাম লেখক ও স্বেচ্ছাসেবী