দীর্ঘ অন্ধকার অধ্যায় শেষে বাংলাদেশের মানুষ আজ নতুন একটি ভোরের মুখোমুখি। দেড় দশকের চরম দুঃশাসন, লুটপাট এবং দুর্নীতির বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা আজ পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পর, এক অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পতন হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন কি যথেষ্ট? প্রশ্ন থেকে যায়- আমরা কি আসলেই একটি ন্যায়নিষ্ঠ, বৈষম্যহীন ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র গড়তে পারব? পতিত স্বৈরাচার টিকে ছিল সর্বগ্রাসী দুর্নীতির দুর্বার চর্চার ওপর ভিত্তি করে। বিগত সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা রাজনীতি কিংবা সরকারি চাকরির মাধ্যমে আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে প্রায় সবাই ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মহানায়ক ছিলেন। এ দেশের প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি এতটাই শেকড় গেঁড়ে বসেছে যে, একে মুছে ফেলা অত্যন্ত কঠিন। শাসক দলের সীমাহীন অর্থলিপ্সা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার জাতিকে এক অসহনীয় অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। তাদের অশুভ জোটে ছিল পুলিশ, আমলা, রাজনীতিবিদ এমনকি কিছু গণমাধ্যমকর্মীও। তারা একযোগে দেশের সম্পদ লুট করেছে, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতকে ধ্বংস করেছে। এই দুর্নীতি স্বৈরাচারী শাসনের রেখে যাওয়া এক ভয়ানক ক্যানসার- যা সমাজের শিরায় শিরায় মিশে গেছে। যদি সমাজকে এই দুর্নীতির বিষাক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত না করা যায়, তবে জনগণ কখনোই স্বৈরাচারের দুঃসহ স্মৃতি এবং দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে না। সরকারি সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিটি খাত দুর্নীতির শিকার হয়েছে। চাকরি পেতে ঘুষ, চিকিৎসা পেতে বাড়তি ফি, এমনকি শিক্ষার্থীদের মেধার বদলে অর্থই নির্ধারণ করেছে তাদের ভবিষ্যৎ। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব, যদি আমরা সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই এবং একে চিরতরে নির্মূল করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিই। প্রথমত, প্রশাসন ও রাজনীতিতে একটি নৈতিক পরিবর্তন আনতে হবে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। জনসম্মুখে দুর্নীতিবাজদের লজ্জিত করার ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন সাহস না করে। সরকারি কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে তারা জনগণের সেবক, আর তাদের বেতন আসে জনগণের করের টাকায়। জনগণের সেবা করা তাদের দায়িত্ব, কোনো সুযোগ নয়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বোঝানোর পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষকদের হতে হবে নৈতিকতার রোল মডেল। তারা শুধু জ্ঞানের দিশারি নয়, বরং চরিত্রের আদর্শ হিসেবেও শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জোগাবেন। তৃতীয়ত, জনগণের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা নিজেদের মধ্যে দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলতে ব্যর্থ হলে এটি কোনোদিনই দূর হবে না। আমাদের প্রত্যেককে একটি অঙ্গীকার করতে হবে: আমি দুর্নীতি করব না, দুর্নীতিবাজদের সমর্থন করব না। দেশে প্রচলিত প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে- দুর্নীতিমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব গঠনের তাগিদ। বাংলাদেশের প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলিম, যারা বিশ্বাস করেন যে, স্রষ্টার সামনে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। ইসলামের মর্মবাণী অনুযায়ী, ভালো চরিত্র একজন ধার্মিক মুসলমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ভালো চরিত্রের অধিকারী কোনো ব্যক্তি কখনোই দুর্নীতির আশ্রয় নেবেন না। তাই, ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক চর্চা সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশ যে রক্ত দিয়েছে, সেই ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর সেরা উপায় হলো একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই আন্দোলন শুধু শাসকের বিরুদ্ধে নয়, বরং আমাদের নিজেদের মধ্যেও একটি পরিবর্তন আনার আহ্বান। আমাদের প্রত্যেককে দায়িত্ব নিতে হবে, প্রতিজ্ঞা করতে হবে এবং কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। একটি সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। বাংলাদেশ এখন এক নতুন পথযাত্রায়। এই যাত্রায় একতাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের।
দুর্নীতি বন্ধে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অঙ্গীকারই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ এবং উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ তখনই সম্ভব, যখন আমরা সবাই মিলে দুর্নীতিকে চিরতরে পরাজিত করতে পারব।
কাজী আশফিক রাসেল : তরুণ কলাম লেখক ও হিউম্যান রাইটস এক্টিভিস্ট