বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সাম্প্রতিক সময়ে উপদেষ্টাদের কিছু বক্তব্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। উপদেষ্টা শারমিন খুরশিদ সম্প্রতি বলেছেন, 'প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল সম্ভাব্য ফ্যাসিস্ট।' তার কয়েকদিন আগেই উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসান প্রশ্ন তুলেছিলেন, 'রাজনৈতিক দল ৫৩ বছর ধরে সংস্কার করেনি কেন?'
এ ধরনের বক্তব্য শুধু বিতর্কিত নয়, বরং দেশের রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণের একটি ধারাকে উস্কে দেয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখেছি, ১/১১-র মতো সময়ে রাজনীতির দোষারোপ করে প্রশাসনিক ও সামরিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য কখনোই শুভ বার্তা বহন করে না।
বিরাজনীতিকরণের ছায়া
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কারের প্রয়োজন আছে- এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। তবে প্রশ্ন হলো, সংস্কারের নামে রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কি গণতন্ত্রের জন্য লাভজনক? প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং মতবিনিময়ের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হয়। কিন্তু যখন রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরা হয়, তখন সেটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নাড়া দেয়।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বকে দুর্বল করার প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। দুর্নীতি দমনের নামে গণতান্ত্রিক চর্চার ওপর কঠোর হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল- যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনো রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে প্রতিফলিত হয়। সংস্কারের প্রশ্নে বাস্তবতা 'রাজনৈতিক দলগুলো ৫৩ বছরে সংস্কার করেনি' এই বক্তব্য বাস্তবতার কতটুকু প্রতিফলন ঘটায়?
বাকশাল বিলুপ্ত হয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সংবিধান সংশোধন, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, এসব গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে।
এসব পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে সংস্কারের ধারা সবসময়ই সক্রিয় ছিল। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা এবং জবাবদিহিতার ঘাটতি আছে- এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
কেন বিরাজনীতিকরণ বিপজ্জনক?
সংস্কারের আড়ালে বিরাজনীতিকরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রাজনীতির বাইরে থেকে যে কোনো শক্তি যদি দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, তার চূড়ান্ত ফলাফল হয় গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হওয়া এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বের অভাব। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট- এ ধরনের মনোভাব রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে এবং জনগণের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা প্রেরণ করে। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তিশালী হওয়া, স্বচ্ছতা এবং জনগণের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন ধারার সংস্কার প্রয়োজন। তবে সেই সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে নয়, বরং তাদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে। বিরাজনীতিকরণ নয়, বরং সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং গঠনমূলক সমালোচনাই দেশের গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করবে।
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র