শিক্ষা মানুষের জীবনে আলোর মতো কাজ করে। এটি মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে সাহায্য করে। শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত উন্নতি নয়, বরং সমাজ ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম হয়। এটি জ্ঞানার্জন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং দক্ষতা অর্জনের প্রধান মাধ্যম।
শিক্ষা ছাড়া জীবন অন্ধকারময় এবং স্থবির। একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি তার অধিকার, দায়িত্ব এবং সমাজে তার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না। ফলে, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে অগ্রগতি ব্যাহত হয়। শিক্ষা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী হতে শেখায়, যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার চাবিকাঠি।
একটি দেশ শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী হতে পারে। শিক্ষিত নাগরিকরা দেশের অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির উন্নয়নে অবদান রাখে। তাই শিক্ষা ছাড়া সবকিছু অচল। মানুষের উন্নয়ন, দেশের অগ্রগতি এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষকতা এমন একটি পেশা- যা জ্ঞান বিতরণ এবং মানুষের জীবনে আলো ছড়ানোর কাজ করে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবই পড়ান না, বরং তাদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, এবং জীবনের সঠিক পথ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন। তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার কারিগর। একজন ভালো শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ নাগরিক হতে অনুপ্রাণিত করেন।
শিক্ষকতা পেশাটি মহান- কারণ, এটি শুধু কর্মজীবন নয়, বরং সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটি মাধ্যম। একজন শিক্ষক জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেন। সমাজের সব পেশার মূলে রয়েছে শিক্ষকদের অবদান। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, লেখক- সবাই শিক্ষকদের হাত ধরে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছায়।
যদিও এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, তবে শিক্ষকেরা তাদের শিক্ষার্থীদের জীবনে পরিবর্তন আনতে নিরলস পরিশ্রম করেন। এই পেশার মাধ্যমে তারা জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই শিক্ষকতা নিঃসন্দেহে একটি মহান পেশা এবং সমাজের অন্যতম সম্মানিত অবস্থান।
প্রকৃত শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দিয়ে থেমে যান না; তিনি তার সারাজীবনের অভিজ্ঞতা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ দিয়ে শিক্ষার্থীর জীবন গড়ে তোলেন। একজন প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত প্রতিভা আবিষ্কার করে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। শিক্ষার্থীদের জীবনের নানা সমস্যায় তিনি বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়ান এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করেন।
শিক্ষক নিজের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষার্থীর মানসিক, নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটান। বইয়ের পাঠ্য শিক্ষার বাইরে তিনি জীবনের বাস্তবতা, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং ভালো-মন্দের পার্থক্য করার গুণ শেখান। একজন প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করেন এবং তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করেন।
প্রকৃত শিক্ষকের অবদান শুধু একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং গোটা সমাজ ও দেশের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের সত্যিকারের সাফল্যের পথ দেখান। একজন শিক্ষকের হাতে অসংখ্য ছাত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়। ফলে, একজন শিক্ষক চাইলেই অন্য পেশার মানুষের মতো যে কোনো কাজ করতে পারেন না। তার জীবন নিয়মতান্ত্রিক এবং দায়িত্বশীলতার একটি আদর্শ উদাহরণ। শিক্ষকের প্রতিটি কর্ম, কথাবার্তা ও আচরণ শিক্ষার্থীদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
শিক্ষক জানেন, তার কর্ম ও নৈতিকতার অনুসারি হলো তার ছাত্ররা। তিনি যদি ভুল কিছু করেন বা দায়িত্বে অবহেলা করেন, তাহলে তার প্রভাব শুধু তার নিজের ওপর নয়, বরং তার ছাত্রদের জীবন এবং তাদের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গিতে পড়বে। অন্য পেশার মানুষের যেখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থাকে, একজন শিক্ষকের সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়।
এ কারণেই শিক্ষকতা পেশা কেবল জ্ঞান বিতরণের নয়, বরং আদর্শ ও নৈতিকতার মূর্ত প্রতীক হওয়ার পেশা। শিক্ষক তার সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিজের দায়িত্ব পালন করেন, কারণ তিনি জানেন, তার ছোট একটি ভুল অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি মহান দায়িত্ব।
বাবা-মা তাদের সন্তানকে একমাত্র শিক্ষকের হাতেই নির্ভয়ে ছেড়ে দেন, কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে শিক্ষকই তার সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন। একজন শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান প্রদান করেন না, তিনি শিক্ষার্থীর নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা দেন। এই আস্থার কারণেই শিক্ষক সমাজে বাবা-মায়ের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন।
বাবা-মা জানেন, শিক্ষক তার সন্তানকে শুধুমাত্র ভালো ছাত্র বানানোর জন্য কাজ করবেন না, বরং তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। শিক্ষক তার অভিজ্ঞতা, ধৈর্য, এবং ভালোবাসার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। তারা শিশুদের মনোভাব বুঝে, তাদের মেধা বিকাশে সহায়তা করেন এবং নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটান। এই বিশ্বাস ও আস্থাই শিক্ষককে সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। বাবা-মা যেমন সন্তানের শারীরিক পরিচর্যার দায়িত্ব নেন, তেমনি শিক্ষক তাদের মানসিক এবং জ্ঞানগত বিকাশের দায়িত্ব পালন করেন। তাই একজন প্রকৃত শিক্ষকই সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের অন্যতম ভিত্তি।
শুধু পড়াশোনা বা উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করলেই একজন ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না। প্রকৃত শিক্ষক হতে হলে ত্যাগ, নিষ্ঠা এবং নিঃস্বার্থতার গুণাবলি থাকতে হয়। একজন শিক্ষক তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, এবং সময় শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করেন। একজন স্বার্থপর মানুষ কখনো শিক্ষক হতে পারে না, কারণ শিক্ষকতা পেশা কেবল জ্ঞান বিতরণের নয়, এটি একটি ত্যাগ ও দায়িত্বের প্রতীক।
শিক্ষক নিজের স্বার্থের চেয়ে শিক্ষার্থীদের মঙ্গলকে প্রাধান্য দেন। তিনি তার ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনের জন্য পরিশ্রম করেন। অনেক সময় নিজের সমস্যা বা কষ্ট গোপন করে শিক্ষার্থীদের সামনে প্রেরণা হয়ে দাঁড়ান। একজন প্রকৃত শিক্ষক কখনো নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবেন না; বরং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ, নৈতিকতা এবং জীবনের সঠিক দিশা দিতে কাজ করেন।
শিক্ষক যে ত্যাগ স্বীকার করেন, তা জাতি ও সমাজের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ। তার এই নিঃস্বার্থতা ও আত্মত্যাগই তাকে একজন প্রকৃত শিক্ষকের মর্যাদা দেয়। তাই শিক্ষকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি মানবতার প্রতি একটি দায়িত্ব ও ত্যাগের উদাহরণ।
সব স্তরের শিক্ষকের অবদানই মহান, তবে প্রাথমিক শিক্ষক জাতি গঠনের অগ্রদূত। কারণ তারা শিশুর জীবনের প্রথম শিক্ষার আলো জ্বালান। শিশুদের শৈশবকাল এমন একটি সময়, যখন তাদের মনে জ্ঞান, নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার বীজবপন করা হয়। এই বয়সে শিশুরা যেমন কৌতূহলী, তেমনি অস্থির। তাদের মনোযোগ ধরে রাখা, শেখার প্রতি আগ্রহী করা ও নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আনা সহজ কাজ নয়। একজন প্রাথমিক শিক্ষক অত্যন্ত ধৈর্য ও ভালোবাসা দিয়ে এই কঠিন কাজগুলো সম্পন্ন করেন।
প্রাথমিক শিক্ষকরা শুধু বইয়ের পাঠ শেখান না, তারা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেন। তারা শিশুদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ তৈরি করেন, সময়ানুবর্তিতা শেখান, এবং নিয়মমাফিক জীবনধারায় অভ্যস্ত হতে সাহায্য করেন। শিশুদের আচরণে পরিবর্তন আনা, তাদের কৌতূহলকে সঠিক পথে পরিচালিত করা ও শেখার আনন্দকে উপভোগ্য করে তোলা- সবকিছুই একজন প্রাথমিক শিক্ষকের হাতে নির্ভর করে। এই বয়সে শিশুদের শেখানো কঠিন, কারণ তাদের মন সহজেই অন্যদিকে চলে যায়। প্রাথমিক শিক্ষকরা সেই অস্থির মনের শিশুদের ধৈর্য ধরে পরিচালনা করেন।
তাদের দায়িত্ব শুধু শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; প্রাথমিক শিক্ষকরা শিশুদের জীবনের প্রথম আদর্শ হিসেবে কাজ করেন। তারা শিশুদের মানসিক ও আবেগিক বিকাশেও ভূমিকা রাখেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের অসীম ধৈর্য, ভালোবাসা এবং শ্রম্নম এই পেশাকে মহৎ করে তোলে। একজন প্রাথমিক শিক্ষক এমন এক স্থপতি, যিনি শিশুদের জীবনের ভিত্তি গড়ে দেন। সেই ভিত্তি যত শক্তিশালী হয়, ভবিষ্যৎ ততটাই উজ্জ্বল হয়।
প্রাথমিক শিক্ষকরা একটি জাতির মেরুদন্ড গঠনে অপরিসীম ভূমিকা পালন করেন। তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা এবং শৃঙ্খলা শেখানোর ক্ষমতা পরবর্তী স্তরের শিক্ষকদের কাজকে সহজ করে তোলে। তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের অবদান শুধু শিশুদের জীবনের জন্য নয়, গোটা সমাজ এবং দেশের অগ্রগতির জন্যও অপরিহার্য।
প্রাথমিক শিক্ষকরা জাতি গঠনের মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেন। তারা শিশুদের জীবনের প্রথম শিক্ষা প্রদান করে তাদের ভবিষ্যৎ ভিত্তি শক্তিশালী করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও তারা প্রাপ্য আর্থিক সুরক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য পেশার তুলনায় কম- যা তাদের জীবনে আর্থিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। এটি তাদের মানসিক চাপ বাড়ায় এবং পেশার প্রতি আগ্রহ হ্রাস করে।
শিক্ষার্থীদের শেখানোর পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষকরা শিশুদের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং সঠিক মূল্যবোধ শেখান। তাদের ধৈর্য, নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম শিক্ষার্থীদের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তাই তাদের কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী বেতন বাড়ানো উচিত। একজন প্রাথমিক শিক্ষক যদি আর্থিকভাবে সুরক্ষিত থাকেন, তবে তিনি আরও মনোযোগ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
সমাজে তাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি করা জরুরি। তারা কেবল একটি পেশায় নিযুক্ত নন, বরং একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা তাদের কাজের মূল্যায়ন এবং শ্রদ্ধার প্রতিফলন। এটি শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত করবে এবং নতুন প্রজন্মকে এই মহান পেশায় যোগ দিতে উৎসাহিত করবে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও সম্মান বৃদ্ধি করলে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও গুণগত পরিবর্তন আসবে। কারণ, একজন সন্তুষ্ট ও সম্মানিত শিক্ষকই তার সেরা সেবা দিতে পারেন- যা জাতির ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে।
হালিমা আক্তার হানি : কলাম লেখক