সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

শিশুদের মানসিক সুরক্ষার অন্যতম বাধা স্মার্টফোন

অভিভাবকদের উচিত শিশুদের খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত করা এবং তাদের জন্য নিয়মিতভাবে সময় ও সুযোগ তৈরি করা। এটি শুধু কান্নাকাটির সমস্যার সমাধান করবে না, বরং তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
হালিমা আক্তার হানি
  ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শিশুদের মানসিক সুরক্ষার অন্যতম বাধা স্মার্টফোন
শিশুদের মানসিক সুরক্ষার অন্যতম বাধা স্মার্টফোন

শিশুদের ফোনের প্রতি আসক্তি বর্তমান যুগের একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে শিশুরা অল্প বয়সেই স্মার্টফোন ব্যবহার শুরু করছে। দীর্ঘক্ষণ ফোনে ভিডিও দেখা, গেম খেলা কিংবা সামাজিক মাধ্যমে সময় কাটানো শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটি শিশুদের স্বাভাবিক শৈশবকালীন অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

ফোন আসক্তির ফলে শিশুরা বাস্তবিক সম্পর্ক এবং সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় তাদের মানসিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে এবং একাকিত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারানো, ঘুমের ব্যাঘাত এবং দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়ার মতো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।

স্মার্টফোন শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে নানা ধরনের ক্ষতি করে। দীর্ঘক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার করলে শিশুর মস্তিষ্কে অতিরিক্ত ডোপামিন নিঃসরণ হয়, যা আনন্দ ও উত্তেজনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে শিশু আসক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এটি শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি এবং সৃজনশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুর মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা সমাধান এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া নীল আলো মস্তিষ্কের ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, যার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। নিয়মিত ঘুমের অভাব মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং শিশুদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়ায়।

শিশুরা কান্নাকাটি করলে তাদের ফোন দিয়ে ভুলিয়ে রাখা একটি ক্ষতিকর অভ্যাস, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। স্মার্টফোনে মনোযোগ নিবদ্ধ করার ফলে শিশুরা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের সৃজনশীলতা ও সামাজিক দক্ষতা হ্রাস পায়। এর পরিবর্তে শিশুদের বহিরাগত খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করা একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প।

খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, যেমন হাড় ও পেশি শক্তিশালী করা, ওজন নিয়ন্ত্রণ করা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। মানসিক দিক থেকেও খেলাধুলা অত্যন্ত উপকারী, কারণ এটি শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, মানসিক চাপ দূর করে এবং দলগত কাজ ও নেতৃত্বের দক্ষতা গড়ে তোলে। এছাড়া প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে শিশুরা নতুন কিছু শেখার সুযোগ পায়।

অভিভাবকদের উচিত শিশুদের খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত করা এবং তাদের জন্য নিয়মিতভাবে সময় ও সুযোগ তৈরি করা। এটি শুধু কান্নাকাটির সমস্যার সমাধান করবে না, বরং তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অনেক অভিভাবক শিশুদের বাইরে খেলাধুলা করতে দিতে ভয় পান, কারণ তারা মনে করেন শিশুরা মাটিতে নোংরা হয়ে যাবে, পড়ে গিয়ে আঘাত পেতে পারে কিংবা কোনো ক্ষতি হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে অনেক সময় তারা শিশুদের ঘরে আটকে রাখেন এবং ব্যস্ত রাখতে ফোন, ট্যাবলেট বা ভিডিও গেমের মতো ডিভাইসের প্রতি অভ্যস্ত করে তোলেন। তবে এই অভ্যাস শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক ক্ষতি করে। ঘরে বসে ডিভাইস ব্যবহার করার ফলে শিশুদের শরীর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, ওজন বৃদ্ধি পায় এবং মানসিক স্থিতিশীলতায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বাইরে খেলাধুলার সুযোগ শিশুরা শুধু শারীরিকভাবেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে না, বরং প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ তৈরি করে। মাটিতে মেশা, ছোটখাটো আঘাত পাওয়া এবং পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে শিশুরা জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শিক্ষা পায়। এসব অভিজ্ঞতা শিশুদের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায় এবং তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। নিয়মিত খেলাধুলার ফলে তাদের হাড় ও পেশি শক্ত হয়, হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে এবং শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়। এছাড়া খেলাধুলা শিশুর মধ্যে শৃঙ্খলা, ধৈর্য এবং দলগত কাজের দক্ষতা গড়ে তোলে।

অভিভাবকদের উচিত তাদের এই অযথা ভীতিগ্রস্ত মনোভাব ত্যাগ করে শিশুদের বাইরে খেলাধুলার জন্য উৎসাহিত করা। শিশুরা যাতে বড় ধরনের আঘাত না পায়, সেজন্য নিরাপদ এবং উপযুক্ত খেলার পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে। তবে সামান্য আঘাত কিংবা মাটিতে নোংরা হওয়া জীবনের স্বাভাবিক অংশ, যা শিশুকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য তাদের প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত রাখা এবং খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাহলে ঘরে বন্দি রেখে এবং ফোনের প্রতি নির্ভরশীল করে অভিভাবকেরা অজান্তেই শিশুদের ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।

হালিমা আক্তার হানি : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে