রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২
নতুন বছর, নতুন আশা

পথশিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার দিকনির্দেশনা

একটি জগৎ কল্পনা করুন, যেখানে কোনো শিশুকে রাস্তায় জীবনযাপন করতে না হয়, যেখানে প্রতিটি শিশুর জীবনে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ রয়েছে। এটি কোনো অপ্রাপ্তিযোগ্য স্বপ্ন নয়। এটি একটি দৃষ্টি- যা ধৈর্য এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।
শরীফ ওবায়েদুলস্নাহ
  ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
পথশিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার দিকনির্দেশনা
পথশিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার দিকনির্দেশনা

নতুন বছরে আমরা সাধারণত নতুন লক্ষ্য স্থির করি, উন্নতির স্বপ্ন দেখি এবং একটি উজ্জ্বল আগামী গড়ার আশা করি। এই আশাবাদের মাঝে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত- সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশের দিকে : পথশিশু।

পথশিশুরা- যারা প্রায়শই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা পরিস্থিতিতে জন্মায়, প্রতিদিন ক্ষুধা, অবহেলা, শোষণ এবং সামাজিক উদাসীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাদের জন্য নতুন বছর মানে উৎসব বা অঙ্গীকার নয়; বরং এটি আরও ৩৬৫ দিন বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কিন্তু এটি কি এমনই থাকতে হবে? এই বছর কি তাদের জন্য পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে?

পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নের দায়িত্ব কেবল সরকার বা এনজিওগুলোর নয়; এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। পরিবার, সম্প্রদায়, করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং নীতিনির্ধারক সবাই এই কাজের অংশ। উন্নয়নের প্রকৃত অর্থই হলো সমতা- কাউকে পেছনে ফেলে না রাখা, বিশেষ করে যারা সবচেয়ে বেশি অসহায়।

এই বছর, আমরা পথশিশুদের সমস্যার মূল কারণগুলো সমাধানের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারি : দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, ভাঙা পরিবার এবং পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। সময় এসেছে সাময়িক সহায়তা, যেমন অনুদান, বিতরণ ইত্যাদির বাইরে গিয়ে টেকসই সমাধানের দিকে মনোযোগ দেওয়ার- যা তাদের জীবনে মর্যাদা, সুযোগ এবং আশার আলো ফিরিয়ে আনে।

দারিদ্র্যের চক্র ভাঙার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো শিক্ষা। অথচ লাখ লাখ পথশিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই সমস্যার সমাধান কেবল স্কুল নির্মাণেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে- যা পথশিশুদের চাহিদা পূরণে সহায়ক। মোবাইল ক্লাসরুম, রাত্রিকালীন স্কুল এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে পারে এর অংশ।

সরকার এনজিও এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বৃত্তি কর্মসূচি, স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা এবং বিনামূল্যে শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি ও থাকা নিশ্চিত করতে পারে। এটি কেবল সাক্ষরতাই নয়, দক্ষতাও বৃদ্ধি করবে- যা তাদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে সক্ষম করবে। সব পথশিশুদেরই প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, বিশেষ করে তাদের যারা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবর্ষ হারিয়েছে। তাদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হতে পারে জীবন পরিবর্তনের হাতিয়ার। কাঠমিস্ত্রি, দর্জি, কোডিং বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো দক্ষতা তাদের স্বনির্ভর এবং সমাজের উৎপাদনশীল সদস্য হয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে।

পুষ্টির অভাব ও স্বাস্থ্যহীনতা পথশিশুদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা- যা তাদের শেখা বা কাজ করার ক্ষমতা সীমিত করে। এই নতুন বছরে কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ, যেমন মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য কর্মসূচি, পথশিশুদের জন্য বিশেষভাবে পরিকল্পিত হতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, স্থানীয় সরকার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অংশীদারিত্ব এই ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে।

ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তি পথশিশুদের সাহায্য করার প্রচেষ্টাকে বহুগুণ বাড়াতে পারে। এমন অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে যা তাদের আশ্রয়দাতা বা আইনি সহায়তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। ক্রাউডফান্ডিং পস্ন্যাটফর্ম শিক্ষা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য সম্পদ সংগ্রহে সহায়ক হতে পারে। তাছাড়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে পথশিশুদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করে লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

এই নতুন বছরে আমাদের উদ্ভাবন এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পথশিশুদের জীবনধারা পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। খাবার, আশ্রয় বা শিক্ষা দেওয়ার বাইরেও, আমাদের তাদের মানবিকতা এবং মানবজাতির প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।

একটি জগৎ কল্পনা করুন, যেখানে কোনো শিশুকে রাস্তায় জীবনযাপন করতে না হয়, যেখানে প্রতিটি শিশুর জীবনে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ রয়েছে। এটি কোনো অপ্রাপ্তিযোগ্য স্বপ্ন নয়। এটি একটি দৃষ্টি- যা ধৈর্য এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।

ঘড়ির কাঁটা যখন এগিয়ে চলেছে, এই বছরটিকে এমন একটি বছর হিসেবে স্মরণীয় করে তুলতে হবে, যখন মানবতা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। নতুন বছর, নতুন আশা- যেন এ বছরে পথশিশুদের হাসি, স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা রাস্তায় প্রতিধ্বনিত হয় বেঁচে থাকার; আর্তনাদ নয়। আমরা একসঙ্গে এটি সম্ভব করতে পারি।

শরীফ ওবায়েদুলস্নাহ : প্রধান নির্বাহী পরিচালক, নবোদ্যম ফাউন্ডেশন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে