বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

মেঠোপথের জনপদে অর্থনীতির বুনন

শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, শিল্পায়নের অসম বিস্তার, মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য, কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পের প্রতি অবহেলা- এসব কারণে গ্রামের অর্থনীতি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। তবে সমস্যা যতই থাকুক, সম্ভাবনার দ্বারও কম নয়। সঠিক নীতিমালা, সুষম উন্নয়ন ও টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি পুনরায় মজবুত করা সম্ভব।
সুদীপ্ত শামীম
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মেঠোপথের জনপদে অর্থনীতির বুনন
মেঠোপথের জনপদে অর্থনীতির বুনন

শহরের উঁচু দালান আর চাকচিক্যময় আলোর বাইরে, যেখানে ভোরের শিশির মাটির গন্ধে মিশে থাকে, যেখানে কাকডাকা ভোরে কৃষকের লাঙল মাঠ চষে চলে, যেখানে কাঁধে ঝুলিয়ে মাছের খাপ নিয়ে জেলে বেরিয়ে পড়ে- সেখানেই টিকে আছে প্রকৃত অর্থনীতির শেকড়।

আমাদের জাতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি গ্রামবাংলার কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প ও শ্রমনির্ভর কর্মসংস্থান। অথচ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, শিল্পায়নের অসম বিস্তার, মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য, কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পের প্রতি অবহেলা- এসব কারণে গ্রামের অর্থনীতি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। তবে সমস্যা যতই থাকুক, সম্ভাবনার দ্বারও কম নয়। সঠিক নীতিমালা, সুষম উন্নয়ন ও টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি পুনরায় মজবুত করা সম্ভব।

কৃষির কান্ডারি, অথচ অবহেলিত :বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষি। শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই কৃষকই বছরের পর বছর নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করছেন। ফসল ফলানোর জন্য দিনরাত খেটে গেলেও লাভের বড় অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। একজন কৃষক যখন ধান ফলান, তখন তার সামনে থাকে নানা বাধা- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চড়া সুদে কৃষিঋণ, কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য ও বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। শহরে বসে আমরা যখন চাল-ডালের দাম বাড়ার হিসাব কষি, তখন গ্রামে বসে একজন কৃষক হিসাব মেলাতে পারেন না, কেন তিনি কষ্টের বিনিময়ে ফসল ফলিয়েও লোকসানের মুখে পড়ছেন। বাজার ব্যবস্থায় কৃষক সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে থাকেন। বাজারে ধানের দাম নির্ধারণ করেন মিল মালিক, আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীরা।

শুধু ফসল নয়, গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগির খামার কিংবা মৎস্য চাষেও কৃষকের অবস্থা প্রায় একই। বাজারে মাছের দাম বাড়লেও জেলে পান না ন্যায্যমূল্য। গরু-ছাগল পালন করেও কৃষক লাভবান হন না, কারণ মধ্যস্বত্বভোগীরাই আসল সুবিধা ভোগ করেন। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তার সুফল সব সময় কৃষকের হাতে পৌঁছায় না।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কৃষকের অসহায়তা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও অনাবৃষ্টির প্রভাব বাড়ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক এ কারণে সর্বস্ব হারান। উত্তরবঙ্গের তিস্তা পাড়ের কৃষকদের কথা ধরা যাক। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানিতে তাদের ফসল নষ্ট হয়, আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হয়। নদীভাঙনে বহু কৃষক জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যে টেকসই ব্যবস্থা দরকার, তা আজও গড়ে ওঠেনি। সরকারি সাহায্য কখনো কখনো এলেও তা যথেষ্ট নয়। দুর্যোগপরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদার না হলে কৃষকের পক্ষে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।

কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসার লড়াই: শুধু কৃষিই নয়, গ্রামের অর্থনীতি টিকে আছে কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপরও। এক সময় বাংলাদেশের প্রত্যেক গ্রামেই তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেতশিল্প, কাঠের তৈরি আসবাবসহ নানা ক্ষুদ্র উদ্যোগ টিকে ছিল। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রতিযোগিতা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং নীতি সহায়তার অভাবে এসব শিল্প বিলুপ্তির পথে। একটা সময় গ্রামীণ হাটগুলোতে কৃষিপণ্যের পাশাপাশি স্থানীয় কারিগরদের হাতে তৈরি নানা সামগ্রী পাওয়া যেত। এখন সেসব জায়গা দখল করে নিয়েছে বিদেশি পণ্য আর বড় ব্যবসায়ীদের আধিপত্য। অথচ সঠিক পরিকল্পনা ও সহায়তা পেলে এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলোই হয়ে উঠতে পারত অর্থনীতির টেকসই ভিত্তি।

হাটবাজারের প্রাণচাঞ্চল্য ও শ্রমিকদের সংগ্রাম: গ্রামের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হাটবাজার। বাংলাদেশে হাজারো গ্রামীণ হাট রয়েছে, যেখানে কৃষিপণ্য, গবাদিপশু, তাঁতের কাপড় ও হাতে তৈরি পণ্যসহ নানা কিছু কেনাবেচা হয়। এসব হাট শুধু ব্যবসার জায়গা নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের স্পন্দন। কিন্তু বর্তমানে এসব হাটেও বড় ব্যবসায়ীদের প্রভাব বেড়ে গেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঠিকে থাকতে পারছেন না। বাজারে বিদেশি পণ্যের দাপট বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় উৎপাদক ও কারিগররা হারিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামের এক বিশাল জনগোষ্ঠী দিনমজুরি বা মৌসুমি শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। নির্মাণকাজ, কৃষিকাজ, মাটিকাটা, ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে তারা কাজ করেন। কিন্তু কাজের নিশ্চয়তা নেই, মজুরি কম, আর মালিকদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেকেই শহরে গিয়ে শ্রমিক হয়ে যান, কিন্তু শহরের জীবনও তাদের জন্য সহজ নয়।

সমস্যার সমাধান কী? গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। গ্রামীণ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং তাদের আয়-রোজগার বৃদ্ধির জন্য কিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এসব উদ্যোগ কৃষি, শিল্প, শ্রম ও পরিবেশের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করবে এবং গ্রামকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে।

কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা : গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি কৃষি। কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়, তার জন্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্ভরযোগ্য কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে- যাতে কৃষকরা তাদের পণ্যের উপযুক্ত দাম পান। এছাড়া, কৃষি বীমা ও ঋণের সুষ্ঠুব্যবস্থা চালু করতে হবে।

কুটিরশিল্পকে বাঁচানো: গ্রামের কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্র উদ্যোগকে বাঁচাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, কাঁচামালের সহজ প্রাপ্যতা এবং এই শিল্পগুলোর বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তিশালীভিত্তি তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া, নতুন প্রযুক্তি ও ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মের মাধ্যমে এই শিল্পগুলোর উৎপাদন ও বিক্রি সহজ করতে হবে।

হাটবাজারের আধুনিকায়ন : গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারের উন্নতি করা জরুরি। এক্ষেত্রে ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে দোকান বরাদ্দ এবং অবকাঠামোগত সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে সাহায্য করা যেতে পারে। পাশাপাশি, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রকে আরও গতিশীল ও বিস্তৃত করা সম্ভব।

শ্রমজীবী মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য উদ্যোক্তা তৈরির প্রোগ্রাম ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষকে প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান এবং তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে করে গ্রাম থেকে শহরমুখী হওয়া কমে যাবে, গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ: গ্রামীণ অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নদীভাঙন, বন্যা এবং খরা রোধের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কৃষকদের সাহায্য করার জন্য প্রযুক্তি ও সম্পদ সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় শক্তিশালী অবকাঠামো নির্মাণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকার ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।

গ্রাম টিকলে দেশ টিকবে। শহর বড় হতে পারে, কিন্তু শহরের জীবনও তো গ্রাম থেকে আসা মানুষের ঘামেই গড়ে ওঠে। আমরা যদি মেঠোপথের এই অর্থনীতির বুননকে শক্তিশালী করতে পারি, তবে সারাদেশই সমৃদ্ধ হবে। উন্নয়নের আলো শুধু শহরে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রত্যন্ত জনপদেও পৌঁছানো দরকার- তবেই অর্থনীতির এই বুনন সত্যিকার অর্থে সফল হবে।

সুদীপ্ত শামীম : লেখক, কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে