মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তাওয়া গ্রামের মতো অনেক অঞ্চল ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু। কারণ মুসলিমদের জন্মহার তুলনামূলক বেশি ছিল।
আরো ৫০ বছর আগের কথা। তখন ভারতে চলছিল ইন্দিরা গান্ধীর শাসন। এ সময় জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় পুরো দেশে। হরণ করা হয় নাগরিক স্বাধীনতা।
আটক করা হয় হাজারো বিরোধী নেতাকে। দমন করা হয় গণমাধ্যমকে। আর বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে শুরু হয় জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি।
তখন ১৯৭৬ সালের নভেম্বর। শীতের এক নীরব রাতে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মেওয়াত অঞ্চলের উত্তাওয়া গ্রামে হানা দেয় পুলিশ বাহিনী। গ্রামটি নয়াদিল্লি থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরের।
ঘোষণা করা হয়, প্রাপ্তবয়স্ক সব পুরুষকে মাঠে একত্রিত হতে হবে। এ সময় সবাই যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, নিজের ঘরে ঠায় বসে ছিলেন মোহাম্মাদ দীনু।
দীনু ও তার ১৪ জন বন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় একটি অব্যবস্থাপিত শিবিরে। দীনুর ভাষায়, ‘এটি ছিল এমন একটি ত্যাগ-সংগ্রাম, যা তাদের গ্রাম ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করেছে।
যখন সবাই পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ বুঝেছিলেন যে যদি কেউ ধরা না পড়ে, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। তাই কয়েকজনকে তুলে দেয়া হয়েছিল।
আমাদের আত্মত্যাগে গ্রামটি বেঁচে গেছে। আজ এই গ্রাম মানুষে পরিপূর্ণ।’
দীনুর বয়স এখন ৯০-এর কোটায়। জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পূর্তিতে দীনুই উত্তাওয়ার একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যাকে সরাসরি এই অভিযানের অংশ হিসেবে লক্ষ্য করা হয়েছিল।
১৯৭৬ সালের এক বছরে প্রায় ৬০ লাখ পুরুষসহ মোট ৮০ লক্ষেরও বেশি পুরুষকে জোর করে ভ্যাসেকটমি করানো হয়েছিল। ভুল চিকিৎসায় হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ২ হাজারজনকে।
‘একটি কবরস্থান, কেবল নীরবতা’
ভারত ১৯৫২ সালে স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছর পর বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করে। তখন পরিবারের সন্তান সংখ্যা দুইয়ের বেশি না রাখতে উৎসাহ দেয়া হতো।
৬০-এর দশকে যখন গড় জন্মহার ছিল প্রতি নারীতে প্রায় ছয় সন্তান, তখন সরকার আরো আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রশাসন ভারতের জনসংখ্যাকে অর্থনীতির ওপর বোঝা মনে করতো, যা তখন ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পশ্চিমাও এই ধারণায় সমর্থন দেয়।
বিশ্বব্যাংক ৬৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়, আর যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সহায়তা নির্ভর করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের ওপর।
জরুরি অবস্থায় এই কর্মসূচি চরমে ওঠে। কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট কোটা দেয়া হয়।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না করলে বেতন বন্ধ বা চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়া হতো। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও সেচের পানি বন্ধ করে গ্রামগুলোকে বাধ্য করা হতো।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তাওয়া গ্রামের মতো অনেক অঞ্চল ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু। কারণ মুসলিমদের জন্মহার তুলনামূলক বেশি ছিল।
দীনুর পাশের গলিতে ১৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ নূর খাটে ঘুমাচ্ছিলেন তার বাবার কোলে। পুলিশ ঘোড়ায় চড়ে এসে বাড়িতে হানা দেয়। তার বাবা জঙ্গলে পালিয়ে যান, আর নূর ভেতরে লুকিয়ে পড়ে।
নূর বলেন, ‘তারা দরজা ও আসবাবপত্র ভেঙে ফেলে। এমনকি ময়দার সাথে বালিও মিশিয়ে দেয়।
গ্রামে একটি বাড়িও ছিল না, যেখানে পরবর্তী চার দিন খাবার রান্না করা গেছে।’ পরে নূরকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে মারধর করা হয়। বয়স ১৫ বছরের নিচে হওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এই ঘটনা জন্ম দিয়েছে একটি লোককাহিনীরও। ঘটনাটি তৎকালীন গ্রামপ্রধান আব্দুল রেহমানকে ঘিরে।
নূর ও তার বন্ধু তাজামুল মোহাম্মদ বলেন, ‘বাইরের কেউ হয়তো তাকে মনে রাখে না। কিন্তু আমরা তাকে মনে রাখি। দুজনেরই বয়স এখন ৬৩।’
‘আমি আমার এলাকা থেকে একটি কুকুরও দেব না’
তাজামুল বলেন, ‘উত্তাওয়ায় অভিযান চালানোর আগে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা গ্রামের প্রধান আব্দুল রেহমানের কাছে এসে কিছু পুরুষকে তুলে দেয়ার অনুরোধ করেন।
কিন্তু রেহমান তাতে রাজি হননি। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ‘আমি এই গ্রাম থেকে কোনো পরিবারকে দিতে পারি না।’ পাশে বসে থাকা নূর আবেগভরে মাথা নাড়েন।
স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, রেহমান কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘আমি আমার এলাকা থেকে একটি কুকুরও দেব না, আর তোমরা আমার কাছ থেকে মানুষ চাচ্ছো? কখনও না।’
নূর বলেন, তবে তার এই দৃঢ় অবস্থানও গ্রামকে রক্ষা করতে পারেনি। অভিযান শেষে উত্তাওয়ায় নেমে আসে শোক।
‘যারা পালিয়েছিল, বা যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা বহুদিন গ্রামে ফেরেনি। গ্রামটি হয়ে উঠেছিল একেবারে কবরস্থানের মতো—কেবল নীরবতা।’
সামাজিক নিষেধাজ্ঞা
পরের বছরগুলোতে এর প্রভাব আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো উত্তাওয়ার পুরুষদের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
স্থানীয় সমাজকর্মী কাসিম বলেন, অনেকেই এই মানসিক আঘাত থেকে আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মানসিক চাপ ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞা তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে।’
আজকের ভারতের প্রতিধ্বনি
বর্তমানে ভারতে আর কোনো জোরপূর্বক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেই। প্রজনন হার এখন গড়পড়তা প্রতি নারীতে দু’টি সন্তানের সামান্য ওপরে।
তবুও বিশ্লেষকদের মতে, ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় যে ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা আজ নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
৭৫ বছর বয়সী সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন বলেন, জরুরি অবস্থা কর্তৃত্ববাদের ভিত্তি গড়ে দেয়। ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ছয় বছরের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করে। ১৩ দিন পর তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেন।
বিশ্বনাথন বলেন, ‘স্বৈরাচারদের অবহেলা থেকেই তৈরি হয় জরুরি অবস্থা, যার কোনো অনুশোচনা ছিল না। আসলে ওই জরুরি অবস্থাই আজকের জরুরি অবস্থা তৈরি করেছে। এটি পরবর্তী ভারত গঠনের ভিত্তি।’
তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর ভক্তরা তাকে দেবী দুর্গার সাথে তুলনা করতেন, যেমন আজ মোদীর অনুগামীরা তাকে দেবতা বিষ্ণুর সাথে তুলনা করে থাকেন। বিশ্বনাথনের মতে, সেই সময় ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক সংস্কৃতি দেশকে ভাবনা-চিন্তা থেকে বঞ্চিত করে তোলে।
তিনি আরো বলেন, ইন্দিরা থেকে মোদি পর্যন্ত, সবাই গণতন্ত্রের মুখোশে এক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনৈতিক বিরোধীদের আটক, বাকস্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও সাংবাদিকদের দমন ইত্যাদি কারণে ভারতের গণতন্ত্র সূচক ও সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার র্যাংকিং দ্রুত কমেছে।
ফ্রি স্পিচ কালেক্টিভ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গীতা সেশু বলেন, ‘তখন যেমন গণমাধ্যম ক্ষমতার সামনে নতি স্বীকার করেছিল, আজও ঠিক তাই। পার্থক্য শুধু এটুকু যে তখন নাগরিক স্বাধীনতা আইন দিয়ে স্থগিত করা হয়েছিল। আর এখন আইনকে অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অসীম আলী বলেন, ‘জরুরি অবস্থার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো একটি শক্তিশালী নির্বাহী নেতৃত্বের সামনে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ কত সহজে ভেঙে পড়ে।’ তবে তার মতে, আরেকটি উত্তরাধিকার ছিল শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া।
১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও তার কংগ্রেস দলকে জনগণ ব্যাপক ভোটে পরাজিত করে। বিরোধীরা তাদের প্রচারণায় সরকারের দমন-পীড়ন, বিশেষত জোরপূর্বক নির্যাতন তুলে ধরেছিল।
আলীশ বলেন, ‘৭০-এর দশকের মতোই ভারতের গণতন্ত্র মোদির পরবর্তী সময়ে পুনরুত্থিত হতে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।’
‘সাত প্রজন্ম!’
১৯৭৬ সালের সেই রাতে দীনুর মনে পড়ে, প্রিজনভ্যানে বসে তিনি ভাবছিলেন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সালিমার কথা, যিনি তখন বাড়িতে ছিলেন। দীনু বলেন, ‘অনেক অবিবাহিত বা নিঃসন্তান পুরুষ পুলিশকে বলছিল, আমাদের ছেড়ে দাও। কিন্তু কাউকে ছাড়া হয়নি।’
‘আমরাই এই গ্রামকে বাঁচিয়েছি’
আট দিন পুলিশ হেফাজতে থাকার পর মোহাম্মদ দীনুকে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তাওয়ার কাছের শহর পালওয়ালের একটি নির্বীজন শিবিরে, যেখানে তার ভ্যাসেকটমি করা হয়। প্রায় এক মাস পর গ্রামে ফিরে আসার পর তার স্ত্রী সালিমা জন্ম দেন তাদের একমাত্র সন্তানের একটি পুত্র।
আজ দীনুর রয়েছে তিন নাতি ও একাধিক প্রপৌত্র-প্রপৌত্রী। দীনু হেসে বলেন, আমরাই এই গ্রামকে বাঁচিয়েছি। নইলে ইন্দিরা এই গ্রামকে আগুনে পুড়িয়ে দিতেন।’
২০২৪ সালে দীর্ঘ অসুস্থতার পর সালিমা মারা যান। এদিকে, দীনু এখনো জীবিত। তিনি তার দীর্ঘায়ু নিয়ে আনন্দিত। এক সময় যিনি দাদুর সাথে খেলতেন, এখন খেলেন নিজের প্রপৌত্র-প্রপৌত্রীদের সাথে।
তিনি প্লাস্টিকের কোল্ড ড্রিঙ্কের কাপ থেকে চুমুক দিতে দিতে বলেন, ‘সাত প্রজন্ম! বলুন তো, কজন এই সৌভাগ্য উপভোগ করতে পারে?’ সূত্র : আল জাজিরা