বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

আত্মহত্যা প্রতিরোধে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবার আগে আত্মহত্যাপ্রবণ লোকদের শনাক্ত করতে হবে। তারপর তাদের আত্মহত্যা থেকে দূরে রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত, তাদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আত্মহত্যা প্রতিরোধে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন

বর্তমান বিশ্বে মানুষের মৃতু্যর ২০টি কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো- আত্মহত্যা। বিশেষত ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সি যুবক-যুবতীরা বেশি আত্মহত্যা করে, যা অপূরণীয় ক্ষতি। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ায় দশম। প্রতি বছরই আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে এবং গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন করে আত্মহত্যা করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম কারণগুলো হলো- মানসিক হতাশা ও বিষণ্নতা, দাম্পত্য জীবনে কলহ কিংবা যে কোনো সম্পর্কে অনৈক্য, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা ও পারিপার্শ্বিক অসহযোগিতা। জরিপ বলছে, 'প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি।' আরও একটি জরিপ বলছে, গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সি মানুষের মৃতু্যর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা।

গত বছর দেশে ১০৫টি জাতীয়, স্থানীয় সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার তথ্য সংগ্রহ করে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। সর্বমোট ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ২২৭ জন (এই হার ৪৪ দশমিক ২), কলেজ শিক্ষার্থী ১৪০ জন (এই হার ২৭ দশমিক ২), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন (এই হার ১৯ দশমিক ১) ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৮ জন (এই হার ৯ দশমিক ৪)। ৫১৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ছিল ২০৪ জন (এই হার ৩৯ দশমিক ৮)। অন্যদিকে, নারী শিক্ষার্থী ছিল ৩০৯ জন (এই হার ৬০ দশমিক ২)। এর আগে ২০২২ সালে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী ছিল ৫৩২ জন। ২০২৩ সালে কিছুটা কমলেও ততটা আশানুরূপ নয়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ১৪৯ শিক্ষার্থী। এরপরই চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৯, রাজশাহী বিভাগে ৭৭, খুলনা বিভাগে ৬৪, সিলেটে ১২, বরিশাল ও রংপুর উভয় বিভাগেই ৪৩ জন করে এবং ময়মনসিংহে ৩৬ জন আত্মহত্যা করেছে।

আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষার্থীরা : বলা হয়েছে, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষার্থী। ৫১৩ শিক্ষার্থীর ৬০ দশমিক ২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত এক বছরে আত্মহত্যা করেছে। শুধু নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা যায় ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী অভিমানে, প্রেমঘটিত কারণে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যৌন হয়রানির কারণে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ও পড়াশোনার চাপে ৪ দশমিক ২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে একই হারে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন শিক্ষার্থীরা।

জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অভিমান- যা সংখ্যায় ১৬৫ জন বা ৩২ দশমিক ২ শতাংশ। এরপরেই প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী, পারিবারিক কলহজনিত কারণে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পর্যালোচনা: আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ২২৭ জনই অর্থাৎ ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ ছিল স্কুলগামী। এছাড়া, আত্মহত্যাকারীদের মাঝে কলেজগামী শিক্ষার্থী ছিল ১৪০ জন- যা ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছিল ৯৮ জন- যা ১৯ দশমিক ১ শতাংশ ও আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছে ৪৮ জন (এই হার ৯ দশমিক ৫)।

কিশোর-কিশোরীদের ঝুঁকি বেশি: বয়ঃসন্ধিকালে নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আবার এই সময়টাতে বেশি রাগ ও অভিমান করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ১৩-১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা- যা সংখ্যায় ৩৪১ জন বা ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২২২ জন নারী শিক্ষার্থী ও এর বিপরীতে পুরুষ শিক্ষার্থী ১১৯ জন। ২০-২৫ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ২৬-৩০ বছরের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২ দশমিক ৩। ১-১২ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক আত্মহত্যা : উঠে এসেছে, ২০২৪ সালে মোট আত্মহত্যাকারী ৫১৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯৮ জন- যা মোট সংখ্যার ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬ জন, সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন, মেডিকেল কলেজের ৬ জন, নার্সিং ইনস্টিটিউটের ৫ জন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ২ জন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন এবং অন্যান্য ১৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ব্যাপকহারে আত্মহত্যার পেছনে যে কারণটি দায়ী সেটি হলো প্রেমঘটিত কারণ- যা ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়েও ২২ দশমিক ৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। বর্তমানে নানা কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। এ হার প্রতি লাখে ৮ দশমিক ৫ জন। আত্মহত্যা প্রতিরোধ একার পক্ষে সম্ভব নয়, সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিতে হবে। 'আত্মহত্যা জীবনে সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়'- উক্তিটি জগদ্বিখ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্টের। ভারতবর্ষের মহান সাধক ফকির লালন সাঁই জীবনকে দেখেছেন আশ্চর্য এক সাধনার মঞ্চ হিসেবে। সেই জীবনের টানেই জীবনানন্দ দাশ কবিতার পঙক্তিতে ঢেলেছেন সুরিয়ালিস্টিক ভাবধারা। মনীষীরা মৃতু্যকে তুচ্ছজ্ঞান করে জীবনকেই করেছেন মহিমান্বিত। তবে কেন এ আত্মহনন? কেন এ জীবনবিমুখতা? চিকিৎসাবিজ্ঞান আত্মহত্যার চেষ্টাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে দেখেন। বিশ্বের অনেক দেশ আত্মঘাতকদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃতু্য ঘটে এর মধ্যে আত্মহত্যা ১৩তম প্রধান কারণ।

বয়স্ক মানুষ হার্ট অ্যাটাকে বেশি মারা যাচ্ছে, বাড়ছে আত্মহত্যাও: ৬০ বছর বয়সি মানুষের মৃতু্যহার হিসাব করলে হার্ট অ্যাটাক প্রথমে। মোট মৃতু্যর ২৩ দশমিক ৮ শতাংশই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এরপরে রয়েছে ব্রেন স্ট্রোক ১১ দশমিক ৫, শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ১১, হার্ট ডিজিস ৬, অ্যাজমা ৫ দশমিক ২, হাই বস্নাডপ্রেশার ৩ দশমিক ৭, ডায়াবেটিস ৩ দশমিক ৩, কিডনি রোগে ২ দশমিক ৯, লিভার ক্যানসার ২ দশমিক ৮, প্যারালাইসিসে ২ দশমিক ২, বস্নাড ক্যানসারে ১ দশমিক ৯, নিউমোনিয়া ১ দশমিক ৫ ও স্টমাক ক্যানসারে ১ শতাংশ মানুষ মারা যান। এসব রোগের বাইরে অন্য কারণে দেশের দশমিক ২ শতাংশ মানুষের মৃতু্য হয়।

অপরাপর কারণের মধ্যে আত্মহত্যা, খুন, সাপের কামড়, সড়ক দুর্ঘটনা ও অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃতু্য অন্যতম। বিবিএস মানুষের মৃতু্যর ১০০টি কারণ উলেস্নখ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম আত্মহত্যা।

আত্মহত্যার কারণ:জেনেটিক: আত্মহত্যার প্রবণতার অন্যতম কারণ জেনেটিক (বংশানুক্রমিক) কারণ। মোট আত্মহত্যার প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই জিন দায়ী। ফলে, কোনো পরিবারে একজন আত্মহত্যা করলে এর প্রভাব অন্য সদস্যদের ওপরও পড়ে।

হঠকারিতা বা ইমপালসিভিটি: আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হঠকারিতাও। মানসিক রোগ না থাকার পরও হঠাৎ করেই অনেকে আত্মহত্যা করে বসেন। ধর্ষিত হওয়ার পরপরই আত্মহত্যা, দাম্পত্য কলহে আত্মহত্যা, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা, প্রিয়জনের মৃতু্য সংবাদে আত্মহত্যা ইত্যাদি- যার মধ্যে অন্যতম।

মানসিক রোগ: আত্মহত্যার জন্য অন্যতম কারণ মানসিক রোগ। বিষণ্নতা, ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ, সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার ও লাভ অবসেশন এর মধ্যে অন্যতম।

প্রত্যাশার মানসিক চাপ: কারও কারও প্রত্যাশা অনেক বেশি। পাশাপাশি পরশ্রীকাতরতাও আছে। কেউ যদি নিজে ব্যর্থ হন এবং পাশাপাশি কাছের কেউ সফল হন তবে সেই গস্নানিবোধ থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

পারিবারিক কলহ: দাম্পত্য কলহের কারণে অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রী আত্মহত্যা করে বসেন। অনেক সময় সন্তানরা বাবা-মায়ের নিত্যকলহের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এ পথে পা বাড়ান।

দারিদ্র্য: বিশেষত, আমাদের উপমহাদেশে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। অনেকে বেশিরভাগ সময় ঋণগ্রস্ত থাকেন। সেটা তার মাথার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। ব্যক্তি তখন চাইলেই ফুরফুরে মুডে থাকতে পারে না। ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে তখন বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।

\হনারীর নিরাপত্তা: নারীর ক্ষমতায়নে সরকার এবং বেসরকারি এনজিও ও উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারীদের আজ ঘরের বাইরে নানা ক্ষেত্রে সরব উপস্থিতি। শিল্পকলকারখানা থেকে শুরু করে শিক্ষা-দীক্ষা এমনকি সামরিক বাহিনীতেও নারীদের জয়জয়কার। কিন্তু নারী ক্ষমতায়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে, কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে ইভটিজিং বা শ্লীলতাহানি বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেককেই আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হন।

রাত জাগার বদভ্যাস: মানসিক রোগে ভুগে আত্মহত্যা করেছেন, তাদের বেশিরভাগেরই অন্যতম উপসর্গ রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়া।

মাদকাসক্তি: মদ্যপায়ীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। হেরোইনসেবীদের আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ১৪ গুণ বেশি। ইয়াবা সেবনেও আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে।

জুয়া খেলা: জুয়াড়িদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। অনেক জুয়াড়ি সবকিছু বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হন। এরপরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন মূলত ঋণের কারণে। এদের ঘরের স্ত্রীদের আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।

দীর্ঘমেয়াদি পীড়াদায়ক রোগ: দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, ক্যানসার, কিডনি নষ্ট হওয়া, অনিদ্রা (ইনসোমনিয়া), হাঁপানি ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি, কষ্টদায়ক ও ব্যয়বহুল রোগের রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কোনো ব্যক্তির ক্যানসার ডায়াগনোসিস হলে তার আত্মহত্যার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

লাভ অবসেশন: অনেক প্রেম 'লাভ অবসেশন' নামে মানসিক রোগের জন্ম দেয়। ফলে, এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভালোবাসার মানুষের সামান্যতম অবহেলাও সহ্য করতে পারেন না। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেতে কিংবা তার বিরহে আত্মহত্যার পথ ধরেন।

আত্মহত্যার লক্ষণ

নিজেকে অন্যের জন্য বোঝা মনে করা বা সীমাহীন কষ্টের কথা প্রকাশ করতে না পারাও আত্মহত্যার অন্যতম লক্ষণ। এছাড়া, হঠাৎ করেই নিজের সব জিনিস অন্যদের দিয়ে দেওয়া, মৃতু্য বিষয়ে নানা চিন্তাভাবনার কথা প্রকাশ করা, আত্মহত্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা, মনের বিক্ষিপ্ততা দৃশ্যমান হওয়া যেমন- একটুতেই উত্তেজিত হওয়া, প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলা, অকারণে কেঁদে ফেলা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে যাওয়া- এসব লক্ষণেও বুঝতে হবে ওই ব্যক্তি হয়ত আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছেন।

আত্মহত্যা প্রবণতারোধে করণীয় :

১. সঙ্গে সঙ্গে রায় না দিয়ে তারা কী বলছে শুনুন। তাদের অভিজ্ঞতা বা আবেগকে অশ্রদ্ধা করবেন না। ২. আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ৩. মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক রোগী, অভিবাসী, বেকার ও সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণিচু্যতদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এ কারণে তাদের প্রতি বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। ৪. আমাদের দেশে যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন এবং উত্ত্যক্তকরণের ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এসব দূর করার জন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর প্রতি নারী-পুরুষ সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করাও আত্মহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবার আগে আত্মহত্যাপ্রবণ লোকদের শনাক্ত করতে হবে। তারপর তাদের আত্মহত্যা থেকে দূরে রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত, তাদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আর মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, কীটনাশক বা বিষ, বিষাক্ত পদার্থ ইত্যাদি দূরে রাখতে হবে। এছাড়া, গণমাধ্যমে আত্মহত্যাবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। তাই আমাদের সবার উচিত আমাদের পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনটা আরও শক্ত করা। একে অপরের খোঁজখবর রাখা। সমাজের সবাইকে সচেতন করে তোলা। তাহলে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসবে। মুছে যাবে আত্মহত্যা নামক শব্দটি। তাই আসুন আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতন হই। প্রিয়জনের জীবন বাঁচাই।

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ :সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে