সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

স্মৃতিতে মহান ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে ছাত্ররা।
আর কে চৌধুরী
  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
স্মৃতিতে মহান ভাষা আন্দোলন
স্মৃতিতে মহান ভাষা আন্দোলন

১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রম্নয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালিদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি পুরান ঢাকার কে এল জুবলি স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন আমাদের ক্লাস শিক্ষক ছিলেন কামরুজ্জামান স্যার। তিনি পরবর্তী সময়ে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে কে এল জুবলি স্কুল কলেজে রূপান্তরিত হলে তিনি কলেজেরও প্রিন্সিপাল হন। তিনি সারাদেশের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। কামারুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ায় স্যারের সঙ্গে আমার সখ্য ছিল। স্যারের নেতৃত্বে আমরা একাধিকবার মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারিতেও আমরা মিছিল সহকারের ভাষা আন্দোলনের জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম।

১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জীবন দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতসহ আরো অনেকে। পরবর্তীকালে একুশে ফেব্রম্নয়ারি দিনটিও পেয়েছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের' অনন্য মর্যাদা। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০০০ সাল থেকে দিনটিকে বিশ্বের সব দেশেই 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের সংগ্রাম ও অবদানের কথা স্মরণ করে বিশ্ববাসী। এর কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার ভাষা থাকলেও মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা যতটা সংগ্রাম করেছে ততটা সংগ্রাম আর দেখা যায় না। সে কারণে একুশের চেতনায় এবং এর অন্তর্গত তাৎপর্যে বিশ্বের সব দেশের মানুষই এখন আন্দোলিত, উজ্জীবিত। তারাও নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার তাগিদ-দায়িত্ব বোধ করে। এখানেই ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রম্নয়ারির বিশেষ তাৎপর্য, অতুলনীয় সফলতা।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে ছাত্ররা।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ববাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। ফলে, শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর পর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলাহ হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবগুলো ছিল, 'বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক।'

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষা বীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম 'রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল।'

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রম্নয়ারি (একুশে ফেব্রম্নয়ারি) সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কর্মসূচির আয়োজন চলার সময় সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ- শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রম্নয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের (১৯০৫-৭৪) সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। ১৪৪ ধারা অমান্য করা হবে কিনা এ প্রশ্নে সভায় দ্বিমত দেখা দেয়, তবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার সংকল্পে অটুট থাকে।

পরদিন বেলা ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের একাংশে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা হয়। সভা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ উপাচার্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। তবে ছাত্র নেতারা, বিশেষ করে আবদুল মতিন এবং গাজীউল হক নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে। ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ছাত্ররা পাঁচ-সাতজন করে ছোট ছোট দলে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্স্নোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে, ছাত্রীরাও এ আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোঁড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত (রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ শ্রেণির ছাত্র) নিহত হয়। বহু আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তাদের মধ্যে সেক্রেটারিয়েটের পিয়ন আবদুস সালাম মারা যায়। অহিউলস্নাহ্‌ নামে আট/নয় বছরের এক কিশোরও সেদিন নিহত হয়।

এ সময় গণপরিষদের অধিবেশন বসার প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলি চালানোর খবর পেয়ে গণপরিষদ সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ এবং বিরোধী দলের সদস্যসহ আরও কয়েকজন সভাকক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন বাংলা ভাষার দাবির বিরোধিতা অব্যাহত রেখে বক্তব্য দেন।

পরদিন ২২ ফেব্রম্নয়ারি ছিল গণবিক্ষোভ ও পুলিশি নির্যাতনের দিন। জনতা নিহতদের গায়েবানা জানাজা আদায় ও শোকমিছিল বের করে। মিছিলের ওপর পুলিশ ও মিলিটারি পুনরায় লাঠিচার্জ ও গুলি চালায়। এতে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন শহীদ হন এবং অনেকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। ছাত্ররা যে স্থানে গুলির আঘাতে নিহত হয় সেখানে ২৩ ফেব্রম্নয়ারি একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে এই অস্থায়ী নির্মাণের জায়গায় একটি কংক্রিটের স্থাপনা নির্মিত হয়।

গণপরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাস করে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে এই আন্দোলন তার লক্ষ্য অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের (১৬ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৫৬) একপর্যায়ে এর সদস্য ফরিদপুরের আদেলউদ্দিন আহমদের (১৯১৩-১৯৮১) দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে