বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থা বর্তমানে মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে জর্জরিত। কৃষি ও ভোগ্যপণ্য বাজারে এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে রমজান মাস এলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণির ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে মজুতদারির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য না কমালে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশের কৃষি খাতে উৎপাদন সন্তোষজনক হলেও কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য যেমন ধান, শাকসবজি বা ফলমূল সরাসরি বাজারে বিক্রি করতে পারে না। তাদের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে হয়- যারা পরে এই পণ্য কয়েকগুণ বেশি দামে শহরের বাজারে বিক্রি করে। ফলে, একদিকে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়; অন্যদিকে, ভোক্তাকে উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি পেঁপে যদি কৃষক ২০ টাকায় বিক্রি করে, সেটি ভোক্তাকে ৬০-৮০ টাকায় কিনতে হয়। একইভাবে চাল, ডাল, সবজি, মুরগি, দুধসহ বিভিন্ন পণ্যে এই মধ্যস্বত্বভোগীরা ব্যাপক মুনাফা করছে।
সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে। প্রতিবার রমজানের আগে চিনি, ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ অন্যান্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। অথচ রমজানের জন্য সরকারের মজুত পর্যাপ্ত থাকে। মূলত আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এছাড়া দাম বৃদ্ধিতে দেশীয় বাজারের ওপর আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবও একটি কারণ হিসেবে ধরা হয়, তবে এটি অনেক ক্ষেত্রে অজুহাত মাত্র। বিশ্ববাজারে যদি কোনো পণ্যের দাম সামান্য বৃদ্ধি পায়, তখন সেটির প্রভাব বাংলাদেশে কয়েকগুণ বেশি পড়ে।
রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। টিসিবির কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন, যাতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা স্বল্প মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেতে পারে। বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে, বিশেষ করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে সরবরাহ চেইন স্বচ্ছ রাখতে হবে, যাতে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য সরাসরি পৌঁছাতে পারে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম আরও সক্রিয় করতে হবে এবং প্রতিদিন বাজার দর প্রকাশ করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পণ্য চোরাচালান রোধ করতে হবে, কারণ এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয় এবং মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিকল্প বাজার ব্যবস্থা তৈরি করাও জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কৃষকদের সহায়তা করে সরাসরি কৃষিপণ্য বিক্রির সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। বর্তমানে কিছু কিছু ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্ম কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য সংগ্রহ করে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে- যা ভালো উদ্যোগ। সরকার চাইলে এই ধরনের প্রকল্পকে বড় পরিসরে নিয়ে আসতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক কঠোরতা। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে অর্থদন্ড ও কারাদন্ডের ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করলে বাজারে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করতে হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে এবং সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দমন করতে হবে। বিশেষ করে রমজানের বাজার স্বাভাবিক রাখতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ন্যায্যমূল্যে পণ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে। এটি শুধু অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যও জরুরি।
তারেক আল মুনতাছির : শিক্ষার্থী, কক্সবাজার সরকারি কলেজ, কক্সবাজার