'টেসলা' এবং 'স্পেসএক্সে'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্ক সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তরুণদের বেশি বেশি বই পড়া আর নেতা হওয়ার প্রবণতা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের কাজে লাগে এমন কিছু করার চেষ্টা করা উচিত। তবে তিনি এও বলেন যে, মানুষের কাজে দেবে এমন কিছু করা বেশ কঠিন।
'ইলন মাস্ক'-এর কথাগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশের তরুণরা কীভাবে নেবে তা জানা নেই। তবে, আমাদের দেশের তরুণ সমাজ যে খুব একটা ভালোভাবে গ্রহণ করবে না, সেটি বলাই যায়! বিশেষ করে যারা নেতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে জীবনের বাদবাকি চিন্তাভাবনা সরিয়ে রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে আরম্ভ করেছেন, তারা তো একেবারেই নয়!
নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কমবেশি সবার মধ্যেই থাকে। পাড়া-মহলস্না হোক কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, নেতৃস্থানীয় একটি 'পদ' বাগিয়ে নিতে এক শ্রেণির মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই! 'পদ' যেন দুর্লভ সোনার হরিণ! 'তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই'- রবি ঠাকুরের কালজয়ী এই গানের কলি যেন সমাজে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মানুষের 'নেতা' হওয়ার ক্ষুধিত বাসনায় দেদীপ্যমান! সততার তোয়াক্কা না করে কিংবা যোগ্যতার ধার না ধেরে, একটি উচ্চ 'পদ' বাগানো চাই-ই চাই! আর সেজন্য অর্থবিত্ত, এমনকি আত্মসম্মানটুকু অকাতরে বিলিয়ে দিতেও তারা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছেন না!
সমাজ কিংবা রাষ্ট্র, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সুযোগ্য নেতৃত্বের আবশ্যকতা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। যদি কেউ অস্বীকার করেন, তাহলে হয় তিনি সত্যকে অস্বীকার করছেন নতুবা রয়েছেন বাস্তবতা থেকে বহু দূরে! আজ যে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আমরা পেয়েছি, তা প্রতিষ্ঠায় নেতাদের অবদান কি অস্বীকার করতে পারি? সেই ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার লড়াই-সংগ্রামে নেতারাই তো অবিচল নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন! তবে, এই ধারাবাহিক সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে নেতৃত্বের বদল হয়েছে বটে। একেক সময়ে একেকজন নেতার নেতৃত্ব আমাদের অভীষ্টে পৌঁছে দিয়েছে। তারা নেতা হতে পেরেছিলেন বলেই আমরা পরাধীনতার শিকল ভাঙতে পেরেছি! তাই তাদের কাছে আমরা চিরঋণী! কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তারা কি কেবল নেতা হওয়ার তাগিদেই রাজনীতিতে এসেছিলেন? আন্দোলন-সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন? নাকি দেশ ও জাতির স্বার্থে নিজেদের উৎসর্গ করার প্রত্যয় নিয়ে রাজনীতিতে এসে পরবর্তী সময়ে নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন? উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে যে সত্য প্রতিভাত হবে, তার সঙ্গে আজকের বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না! ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্দি যেসব প্রাতঃস্মরণীয় নেতার আবির্ভাব ঘটেছে, তারা জীবনের প্রারম্ভেই নেতা হওয়ার বাসনায় রাজনীতিতে নাম লেখাননি! বরং সময় এবং প্রয়োজন তাদের নেতার আসনে সমাসীন করেছে। আর জনগণ তাদের সাধুবাদ জানিয়েছে; কেননা, নেতৃত্বে আসীন হওয়া সেই ব্যক্তিরা আত্মস্বার্থ নয়, দেশ ও জাতির কল্যাণ চিন্তাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। স্বাধীনতা, অধিকার হারা মানুষের অধিকার আদায় এবং নির্যাতিত মানুষের পক্ষে তারা রেখেছেন অসামান্য অবদান! আর তা করতে গিয়ে তারা শিকার হয়েছেন শাসক-শোষকের জুলুম-নির্যাতনের!
তরুণদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ নেতা! নেতা তারাই হবেন, যারা প্রকৃতপক্ষে এই যোগ্যতাকে ধারণ করেন! বর্তমানে আমাদের দেশে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অধিকাংশ তরুণই বস্তুত কর্মী হিসেবে থাকতে চান না, নেতা হতে চান! তারা হয়ত ভুলেই গেছেন যে, উপমহাদেশে যারাই নেতা হয়েছেন, তারা কেউ এক লাফে গাছের মগডালে চড়ে বসেননি বরং ধীরে ধীরে গোড়া থেকে ওপরে উঠেছেন! তারা সবাই কর্মী হয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করে, কর্মদক্ষতা আর যোগ্যতার বদৌলতে হয়ে উঠেছিলেন সুযোগ্য নেতা! কিন্তু আজকালকার তরুণরা সে পথে হাঁটতেই নারাজ! তারা দ্রম্নত পৌঁছে যেতে চায় নেতৃত্বের মসনদে!
তরুণদের মধ্যে নেতা হওয়ার প্রবণতা থাকাই কাম্য। তবে তা সমগ্র চিন্তাচেতনাকে গ্রাস করে নয়! কারণ, মানুষের মৃতু্যর চেয়ে মনুষ্যত্বের মরণ বেশি বেদনাদায়ক! হতে হবে একজন নিখাদ সাদা মনের মানুষ! নেতা হওয়ার লক্ষ্য থাকবে মানবকল্যাণ! আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে নেতা হওয়ার বাসনা অবশ্যই পরিত্যাজ্য!
আসিফ আল মাহমুদ : কলাম লেখক