স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ১৯৪২ সালে ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ডে জন্ম নেন। তার বাবা ছিলেন একজন জীববিজ্ঞানের গবেষক। তিনি স্টিফেন হকিংয়ের মাকে নিয়ে জার্মানের বোমার আঘাত থেকে বাঁচার জন্য লন্ডনে পালিয়ে আসেন।
হকিং লন্ডন এবং সেন্ট অ্যালবানসে বেড়ে ওঠেন। তিনি অক্সফোর্ডে পদার্থবিদ্যার ওপর প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি অর্জন করে ক্যামব্রিজে কসমোলজির ওপর স্নাতকোত্তর গবেষণা করেন। কেমব্রিজে গবেষণা করার সময় তার মোটর নিউরন রোগ ধরা পরে যেটা তাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অচল করে দেয়। ১৯৬৪ সালে চিকিৎসকরা বলেছিলেন তিনি বড় জোর দুই থেকে তিন বছর বাঁচবেন। কিন্তু রোগটি যতটা দ্রম্নততার সঙ্গে ছড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছিল তার চেয়ে কম গতিতে ছড়ায় তার শরীরে। ১৯৮৮ সালে তার 'এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম' বইটি প্রকাশিত হয়। বইটির প্রায় এক কোটি কপি বিক্রি হয়- যদিও লেখক জানতেন যে বইটির পরিচিতি হয়েছে 'পঠিত হয়নি এমন সর্বাধিক বিক্রীত বই' হিসেবে।
১৯৮৮ সালের মধ্যে হকিংয়ের অবস্থা এমন হলো যে, তিনি শুধুমাত্র কৃত্রিম উপায়ে কথা বলতে পারতেন। জীবদ্দশায় তিনি বেশ কিছু টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন এবং তার কৃত্রিম কণ্ঠস্বরে কথা বলেছেন।
তিনি রসবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ ও বিজ্ঞানের একজন জনপ্রিয় দূত ছিলেন। তিনি সব সময় নিশ্চিত করতেন যেন তার কাজ সাধারণ মানুষেরা সহজে বুঝতে পারেন।
তবে তার 'থিওরি অব এভরিথিং' মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। যাতে তিনি ধারণা দেন যে, মহাবিশ্ব কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই বিবর্তিত হয়।
'এই মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হলো- এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এসব নিয়ম', তিনি বলেন, 'কবে এর শেষ হবে? কীভাবে শেষ হবে? এসবের উত্তর যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আমরা আসলেই ঈশ্বরের মন বুঝতে পারব'।
তার ভঙ্গুর শারীরিক অবস্থা সত্ত্বেও তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লুকেসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে তার কাজ চালিয়ে যান এবং ২০০১ সালে তার দ্বিতীয় বই- ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল প্রকাশিত হয়।
স্টিফেন হকিং দেখান যে কৃষ্ণ গহ্বর কীভাবে শক্তিক্ষয় করতে করতে শূন্যে মিলিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিতি পায়। কঠিন গাণিতিক হিসাব এবং পরীক্ষা ছাড়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় তুলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতার কারণে তিনি বিশেষভাবে পরিচিতি পান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তার অসুস্থতা তার জন্য কিছু উপকারও এনে দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি জীবন নিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য তার শারীরিক অবস্থা অবধারিতভাবেই তাকে অন্যদের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে।
২০০৭ সালে তিনি প্রথম চলৎশক্তিহীন ব্যক্তি হিসেবে একটি বিশেষ বিমানে ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নেন। মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই তিনি এটি করেন। ৬৫ বছর বয়সে স্টিফেন হকিং জিরো গ্র্যাভিটি অনুভবের জন্য বিশেষায়িত এক বিমানে চড়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জিরো গ্র্যাভিটি করপোরেশনের বিশেষায়িত বিমানে এমন সুবিধা রয়েছে যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে যে কেউ চাইলেই পৃথিবীতে থেকেই মহাশূন্যে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে পারে। এই ফ্লাইট অল্প সময়ের জন্য কয়েকটি স্তরে অভিকর্ষবিহীন পরিবেশ তৈরি করে। এটি ঠিক মহাশূন্যে ভ্রমণের মতোই। তবে স্টিফেন হকিং যে শখের বশে এই ভ্রমণ করেছেন, তা কিন্তু নয়। মহাশূন্য সম্পর্কে মানুষকে আরও বেশি উৎসাহী করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, 'ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীর বাইরে মানুষের জন্য একটি বিকল্প ধারার আবাসন তৈরি করার প্রয়োজন হতে পারে।' এই ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি মহাকাশ সম্পর্কে কাজ করা বিজ্ঞানীদের আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি মহাকাশ সম্পর্কে মানুষের মনের ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করার মাধ্যমে মহাকাশ সম্পর্কে সবাইকে আরও বেশি করে উৎসাহী করে তুলতে চেয়েছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, পারমাণবিক যুদ্ধ ও জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি ভাইরাস অথবা অন্য কোনো কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অবসান হতে পারে। মানুষ যদি মহাকাশে না যায় তাহলে আমার মনে হয় মানবজাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যে কারণে আমি মানুষকে মহাকাশে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাই'।
ডিসকভারি চ্যানেলের সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পৃথিবীর বাইরে কোনো বুদ্ধিমান জীবনের উপস্থিতি আছে এমন ধারণা করাটা সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসীরা প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে পৃথিবীতে অভিযান চালাতে পারে।
স্টিফেন হকিং ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী এলিয়েনের অস্তিত্ব কখনোই অস্বীকার করেননি। ২০০৮ সালে নাসার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হকিংকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ডযু ডব ঝযড়ঁষফ এড় ওহঃড় ঝঢ়ধপব শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে হকিং বেশ শক্ত তথ্য-উপাত্তসহ বলেন,
'পৃথিবীর বাইরে কোনো এলিয়েন সম্প্রদায় থাকাটা একদমই অসম্ভব কিছু নয়। দেখুন, এই মহাবিশ্বের ব্যাপকতা আসলে আমাদের ধারণার বাইরে। আমরা মহাবিশ্বকে যতটা বড় ভাবি, এটি আসলে তার থেকেও হাজার হাজার গুণ বড়। মহাবিশ্বের অনেক অংশ সম্পর্কে আমাদের আদৌ কোনো ধারণাই নেই। কাজেই পৃথিবীর বাইরে যেকোনো বর্বর অথবা মানুষের চেয়েও বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো প্রাণী বা সম্প্রদায় নেই, একথা আমরা বলতে পারি না।
দীর্ঘদিন ধরে মোটর নিউরন ডিজিজের সঙ্গে লড়াই করে স্টিফেন হকিং ১৪ মার্চ ২০১৮ সালে ৭৬ বছর বয়সে মারা যান।
হকিংয়ের আরেকটি উলেস্নখযোগ্য কাজ- তিনি একটি শিশুতোষ ফিকশনের লেখক! তার কন্যা লুসি হকিংকে সঙ্গে নিয়ে লিখেছিলেন জর্জ'স সিক্রেট কী টু দ্য ইউনিভার্স নামের এক কিশোর সায়েন্স ফিকশন। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের কাহিনি জর্জ নামক এক প্রযুক্তিপ্রেমী কিশোরকে নিয়ে। একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে তিনি এই বইটি লিখেছিলেন। তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল, পদার্থবিদ্যার জটিল বিষয়গুলো, বিশেষ করে কৃষ্ণবিবর এবং সৃষ্টিতত্ত্বের মতো কঠিন বিষয়গুলো, খুব সহজভাবে কিশোরদের সামনে উপস্থাপন করা। বইটির দ্বিতীয় কিস্তি ২০০৯ সালে এবড়ৎমব্থং ঈড়ংসরপ ঞৎবধংঁৎব ঐঁহঃ নামে প্রকাশিত হয়।
অসংখ্য সম্মাননা-স্বীকৃতি পেলেও নোবেল পুরস্কার ছিল অধরা।
তার পাওয়া স্বীকৃতি এবং সম্মাননার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে-
লন্ডনের রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ (১৯৭৪)।
বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ষষ্ঠ পোপ পলের হাতে রজার পেনরোজ পদক।
রয়েল সোসাইটি থেকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পুরস্কার এবং হিউজেজ পদক।
১৯৭৯ সালে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপকের পদ অর্জন। উলেস্নখ্য, স্যার আইজ্যাক নিউটন ১৬৬৩ সালে এই পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
আশির দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কমান্ডার নাইট উপাধি।
জাতীয় সেবায় অবদানের জন্য কম্প্যানিয়ন অব অনার উপাধি।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকে সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব।
১২টিরও বেশি সম্মাননাসূচক ডিগ্রি।