শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

কার্জন হল

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ১১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
কার্জন হল

কার্জন হল উপমহাদেশের মধ্যে ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ ১১৬ বছরের ইতিহাস। সাতচলিস্নশের দেশভাগ, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষী এই হলটি।

কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত পুরনো একটি ঐতিহাসিক ভবন ও পুরাকীর্তি। বর্তমানে কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান অণুষদের পাঠদানে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইউরোপ ও মোগল স্থাপত্য রীতির অপূর্ব সংমিশ্রণে নির্মিত দ্বিতল এই কার্জন হল ভবনকে ঢাকার অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভবনের বহির্পৃষ্ঠে কালচে লাল রঙের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। আধুনিক স্থাপত্য বিদ্যা এবং মোগল কাঠামোর সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এর খিলান ও গম্বুজগুলো। লাল রঙা কারুকার্যময় এই ভবনের অভ্যন্তরে রয়েছে বিশাল একটি কেন্দ্রীয় হল। কার্জন হলের সামনে রয়েছে একটি সুন্দর বাগান। একটি চমৎকার রাস্তা পশ্চিম থেকে পূর্বে বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। ভবনের পেছনের দিকে রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মুসা খাঁ মসজিদ, একটি বিশাল পুকুর ও শেরে বাংলা ফজলুল হক হলের মূল আবাসিক ভবন। কার্জন হলের উল্টো দিকের রাস্তার অন্য পাশে রয়েছে শিশু একাডেমি এবং ঐতিহ্যবাহী দোয়েল চত্বর।

১৯০৪ সালে ফেব্রম্নয়ারিতে পূর্ব বাংলা সফর করেন লর্ড কার্জন। ঢাকা তখন নিতান্তই একটি মফস্বল, বাংলার রাজধানী নয়। আয়তনেও খুব বেশি বড় ছিল না। তখন বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্তই ছিল ঢাকার বিস্তৃতি।

তৎকালীন গভর্নর জেনারেল জর্জ কার্জন ১৯০৪ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি এই ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং তারই নামানুসারে এ ভবনের নাম হয় কার্জন হল। যার নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯০৮ সালে।

বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার পর প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য রমনা এলাকায় যেসব ইমারতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় কার্জন হল তার মধ্যে অন্যতম। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে, ঢাকা কলেজের ক্লাস নেওয়া হতে থাকে কার্জন হলে। পরবর্তী সময়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে কার্জন হল অন্তর্ভুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের জন্য, যা আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে কার্জন হল জড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখানেই ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তৎক্ষণাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিশেষ সমাবর্তনে জিন্নাহের এই ঘোষণার প্রতিবাদে কার্জন হলে উপস্থিত ছাত্ররা 'নো-নো' বলে প্রতিবাদ করে। ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক ইতিহাসের সঙ্গে এভাবেই জড়িয়ে যায় কার্জন হলের নাম। বাংলার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষী কার্জন হল।

ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানে এ হলের ভূমিকা অপরিসীম। সে সময়ে সব আন্দোলন সংগ্রামের মূলকেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ কার্জন হল। একইভাবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও কার্জন হলের নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার মতে, কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল মূলত একটি টাউন হল হিসেবে। উনিশ শতকের শেষদিক হতে শুরু হওয়া ঢাকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির জন্য এই টাউন হলটি নির্মিত হয়। ইতিহাসবিদ আহমেদ দানী বাংলাপিডিয়ার এ মতের প্রতি সমর্থন দেন। তবে আরেক ইতিহাসবিদ শরীফউদ্দিনের মতে, এ তথ্যটি সঠিক নয়। তিনি বলেন, কার্জন হল নির্মাণ করা হয়েছিল ঢাকা কলেজের সম্প্রসারিত ভবন হিসেবে এবং এর জন্য অনুদান প্রদান করেন ভাওয়ালের রাজকুমার। ১৯০৪ সালের ঢাকা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখা যায় যেখানে বলা হয়েছে, 'ঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এই কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য সুযোগ্য প্রিন্সিপাল রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন। বড়লাট বাহাদুরের আগমনে ভাওয়ালের রাজকুমাররা এ অঞ্চলে লর্ড বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্তে কার্জন হল নামের একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা এ স্থাপত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনার্থীর জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থান। ব্রিটিশ স্থাপত্যের স্বাদ নিতে প্রতিদিনই এখানে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়। নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড্ডা ও পদচারণায় স্থানটি মুখরিত থাকে। সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল থাকা এ ভবনের পাশেই রয়েছে ফজলুল হক মুসলিম হল ও শহীদুলস্নাহ হল। মাঝে এক মনোরম পুকুর স্থাপত্যটিকে দিয়েছে আলাদা আকর্ষণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে