মির্জা নাসির উদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন জন্মগ্রহণ করেন ৬ মার্চ, ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট। যিনি ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দ এবং ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুই দফায় আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। তিনি ছিলেন এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের পুত্র। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে দিলিস্নর সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি তার পিতা বাবরের মতোই তার রাজত্ব হারিয়েছিলেন। কিন্তু পারস্য সাম্রাজ্যের বাদশাহ শাহ তাহমাস্পের সহায়তায় পরিনামস্বরূপ আরও বড় রাজ্য পেয়েছিলেন।
গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের সঙ্গে হুমায়ুন প্রথম থেকেই সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন এবং পূর্বদিকে তাঁর জন্য বড় একটি বিপদ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছিল। এসময়ে উদীয়মান আফগান নেতা শেরখান পূর্বাঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন। তিনি ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে সুরজগড়ের যুদ্ধে বিহারের জালাল খান লোহানী এবং বাংলার মাহমুদ শাহের যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করে বিহারের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন।
শেরখান গৌড় অধিকার করেন এবং সুলতান মাহমুদ শাহকে বিপুল পরিমাণ কর প্রদানে বাধ্য করেন। শেরখানের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হুমায়ুনকে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ কারণে তিনি পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে চুনার অধিকার করেন। ইতোমধ্যে শেরখানের হাতে গৌড়ের পতন ঘটে (১৫৩৮ খ্রি)। বিতাড়িত সুলতান মাহমুদ শাহের অনুরোধে সম্রাট হুমায়ূন দ্রম্নত গৌড়ের দিকে অগ্রসর হন। শেরখান হুমায়ুনকে বাধা দেননি। মোটামুটিভাবে কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়েই হুমায়ুন গৌড়ে প্রবেশ করেন। সম্রাট হুমায়ুন বাংলার রাজধানীর নতুন নামকরণ করেন 'জান্নাতাবাদ' এবং হুমায়ুন এখানে ছয়মাস অবস্থান করেন।
এদিকে শেরখান বিহার পুনরুদ্ধার করেন এবং বেনারস ও কনৌজ পর্যন্ত এলাকা দখল করে নেন। তিনি সম্রাটের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন, শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন এবং রাজধানীতে তাঁর পুনরাগমনে বাধা দিতে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেন। গৌড়ে জাহাঙ্গীর কুলী খানের অধীনে পাঁচ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী রেখে হুমায়ুন পশ্চিমের দিকে এগুতে শুরু করেন এবং ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে বক্সার-এর নিকটবর্তী চৌসা নামক স্থানে পৌঁছেন।
শেরখানের সৈন্যবাহিনী মুগলদেরকে অতর্কিত আক্রমণ করলে মুগল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। চৌসার যুদ্ধে শেরখান বিজয় লাভ করে নিজেকে একজন স্বাধীন ও র্সাবভৌম ক্ষমতার অধিকারী শাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। এসময় তিনি শেরশাহ উপাধি ধারণ করেন। চৌসার যুদ্ধের পরপরই শেরশাহ জাহাঙ্গীর কুলী খানকে পরাজিত করেন এবং বাংলা দখল করে নেন।
চৌসার যুদ্ধে পরাজয়ের পর হুমায়ুন শেরশাহের সঙ্গে চূড়ান্ত শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে কনৌজের যুদ্ধেও পরাজিত হওয়ার কারণে একদিকে হুমায়ুনকে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয় এবং অন্যদিকে আফগান সালতানাত পুনরুদ্ধারে শেরশাহ সমর্থ হন।
হুমায়ুন যখন ২২ বছর বয়সে ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি একজন অনভিজ্ঞ শাসক ছিলেন। তার সৎ ভাই, কামরান মির্জা তাদের পিতার সাম্রাজ্যের উত্তরতম অংশ কাবুল এবং কান্দাহার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। পরে মির্জা হুমায়ুনের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে।
হুমায়ুন শেরশাহ সুরির কাছে পরাজিত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন, কিন্তু সাফাভি রাজবংশর সহায়তায় ১৫ বছর পরে তা পুনরুদ্ধার করেন। কনৌজের যুদ্ধের পর হুমায়ুন প্রায় ১৫ বছর গৃহহীন অবস্থায় যাযাবরের মতো জীবনযাপন করেন। এরপর, হুমায়ুন খুব অল্পদিনের মধ্যে সাম্রাজ্যের সীমা বৃদ্ধি করেন।
১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে অমরকোটে হুমায়ুনের পুত্র আকবরের জন্ম হয়। এরপর হুমায়ুন দ্রম্নত পারস্যের দিকে অগ্রসর হন। পারস্যের শাহ তামাস্প (ঝযধয ঞধসধংঢ়) হুমায়ুনকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং শত্রম্ন মনোভাবাপন্ন ভাইদের হাত থেকে তাকে কাবুল ও কান্দাহার পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন। হুমায়ুন সরহিন্দে সিকান্দার শূরের নেতৃত্বাধীন আফগান বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে দিলিস্ন ও আগ্রা পুনর্দখল করেন। কিন্তু নিজের সাম্রাজ্যসীমা পুনরায় বৃদ্ধি এবং এটিকে সংহত করার মতো দীর্ঘ সময় তিনি বেঁচে থাকেননি।
নাসিরউদ্দীন মুহাম্মদ হুমায়ুন ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জানুয়ারি দিনপানাহ নামক শহরে তার নিজ গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মৃতু্যবরণ করেন।